রহমত রহমান: দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি সেরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, ২০০৯’ পদক অর্জন করে। তবে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে আয় গোপনের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রায় ২৯ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে প্রায় ১১ কোটি টাকার আয়কর পরিশোধ করেনি ব্যাংকটি।
রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এ প্রতিবেদন দেয়া হয়। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ঢাকা ও চট্টগ্রাম কার্যালয়ের ২০১৯-২০ করবর্ষের ওপর আয়কর নির্ধারণের সঠিকতা যাচাইয়ের ওপর কমপ্লায়েন্স অডিট (২০২০ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর) সম্পন্ন করেছে। এতে ২৭টি প্রতিষ্ঠানের (ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান) বিপরীতে মোট ১৫৮ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার ৮৪৮ টাকার অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয়, যার মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের অনিয়ম উঠে এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম পর্যালোচনা ও পরিহার করা রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া এবং সরকারি কোষাগারে জমা নিশ্চিত করতে এনবিআরকে সম্প্রতি প্রতিবেদন দেয়া হয়।
এতে বলা হয়, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড এনবিআরের আওতাধীন এলটিইউ, আয়কর শাখার একটি করদাতা প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকটির ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষাকালে আয়কর নথি, বার্ষিক নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী ও অন্যান্য রেকর্ড পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, করদাতা কোম্পানি আয়কর রিটার্নের সঙ্গে বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল করেছে, যাতে (বার্ষিক প্রতিবেদন নোট-৩৮) ‘আদার এক্সপেন্স’ হেডে ‘সেলারি অ্যান্ড অ্যালাউন্স’, ‘আউটসোর্সিং স্টাফ’ বাবদ ৩১ কোটি ২৯ লাখ ৩৫ হাজার ৫৬৩ টাকা খরচ দাবি করেছে, যা জনশক্তি সরবরাহ হিসেবে বিবেচিত।
আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, দাবিকৃত খরচের ওপর দুই শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনযোগ্য। আউটসোর্সিং স্টাফ খরচের মধ্যে করদাতা প্রতিষ্ঠান তিন খাতে মোট দুই কোটি ৬৪ লাখ ১৯ হাজার ৪১৪ টাকা খরচের বিপরীতে প্রমাণাদি দাখিল করেছে। বাকি ২৮ কোটি ৬৫ লাখ ১৬ হাজার ১৪৯ টাকার ওপর উৎসে কর কর্তনের কোনো প্রমাণাদি নিরীক্ষায় পাওয়া যায়নি। ফলে আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এই খরচ অননুমোদনযোগ্য খরচ হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনে (নোট-৩৮) ‘বিজনেস প্রমোশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ বাবদ ১৩ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার ৭২৪ টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। এছাড়া ভ্যাট দাবি করা হয়েছে ৩২ লাখ ৯৮ হাজার ১২৯ টাকা। ভ্যাট বাদে এ খাতে নিট খরচ দাবি করা হয়েছে ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৮২ হাজার ৫৯৫ টাকা। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, দাবিকৃত এই খরচের ওপর এক দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৭২৯ টাকা উৎসে কর কর্তনযোগ্য। কিন্তু কর্তন করা হয়েছে ২৫ হাজার ৪৪ টাকা, যার আনুপাতিক হারে ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৬০০ টাকা।
আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এই খরচ অননুমোদনযোগ্য খরচ হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হবে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই অর্থবছর দুটি খাতে মোট ২৮ কোটি ৮১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৪৯ টাকা আয়ের ওপর আয়কর পরিশোধ না করে পরিহার করার মতো অনিয়ম করেছে। পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত ব্যাংক হিসেবে এর ওপর ৩৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে প্রযোজ্য কর দাঁড়ায় ১০ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৬৫৬ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করদাতা কোম্পানি ২০১৯-২০ করবর্ষে ৮২ বিবি ধারায় আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে, যাতে আয় প্রদর্শন করেছে ৬৮৫ কোটি ৪৯ লাখ ৭৩ হাজার ৭৮৩ টাকা। ওই অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি আয় গোপন করেছে ২৮ কোটি ৮১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৪৯ টাকা টাকা। অডিট অধিদপ্তর কর্তৃক ওই অর্থবছর প্রতিষ্ঠানের মোট আয় পেয়েছে ৭১৪ কোটি ৩১ লাখ ৫৯ হাজার ৫৩২ টাকা (২৮ কোটি ৮১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৪৯ টাকাসহ)। এর ওপর প্রযোজ্য কর ২৬৩ কোটি ৮৬ লাখ এক হাজার ৪৬৩ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ করেছে ২৫৩ কোটি পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৮০৭ টাকা। বাকি ১০ কোটি আট লাখ ৬৯ হাজার ৬৫৬ টাকা ব্র্যাক ব্যাংক অনিয়মের মাধ্যমে পরিশোধ করেনি। করদাতা কোম্পানি ৮২ বিবি ধারায় রিটার্ন দাখিল করায় অনিয়মের বিষয়টি পরীক্ষা করে পরে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অডিট অধিদপ্তরকে জানাতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম আর এফ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমার জানা নেই। ট্যাক্স-ভ্যাট দেখেন ডিএমডি ও সিএফও মোহাম্মদ মাসুদ রানা।’ তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
পরে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মোহাম্মদ মাসুদ রানা এফসিএ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা এ ধরনের রিপোর্ট এখনও পাইনি, আমাদের জানানো হয়নি। চিঠি না পেলে কিছু বলতে পারব না। তবে আমাদের ফাইলে কোনো ডিসফিউট বা গ্যাপ নেই।’
সূত্রমতে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ২০০১ সালে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। মূল প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংক বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সূচনা করে। ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের প্রায় অর্ধেক অংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, সংক্ষেপে যাদের বলা হয় এসএমই। বর্তমানে সারাদেশে এ ব্যাংকের ১৮৭টি শাখা ও ৪৫৭টি ইউনিট রয়েছে।
২০০৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ব্যাংকটি। এ ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন দুই হাজার কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ৩২৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ব্যাংকের ৪৬ দশমিক ২৪ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা পরিচালকদের, ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ৩৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ার বিদেশি ও পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে। সর্বশেষ হিসাববছর (২০২০) ব্যাংকটি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য সাড়ে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নগদ ও পাঁচ শতাংশ বোনাস।