তিন কারণে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কারণগুলো হলো- গ্রেপ্তার, মামলা ও ধরপাকড় এড়ানো; চাপে পড়ে অনেক নেতার পদত্যাগ এবং কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিবেচনা। এ ছাড়া বড় ধরনের ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সংগঠনটির শীর্ষনেতারা। হেফাজতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর ঘোষণার পাঁচ মাসের মধ্যেই ভেঙে দেওয়া হলো হেফাজতের এ কমিটি।গত রবিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ভিডিওবার্তায় কেন্দ্রীয়সহ ঢাকা মহানগরের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এর তিন ঘণ্টার মধ্যেই আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে। অন্য সদস্যরা হলেন- বিলুপ্ত কমিটির প্রধান উপদেষ্টা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী, সদস্য সালাহ উদ্দিন নানুপুরী ও অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান।হেফাজতের কমিটি বিলুপ্তি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, সরকারের ধরপাকড়ে শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছে হেফাজত। কেউ বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপাতত কিছু দিন চুপচাপ থেকে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আবারও সক্রিয় হবেন তারা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতায় হেফাজত মাঠে নামার
পর দেশের কওমি মাদ্রাসার ওপর নজরদারি বেড়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন হেফাজত নেতারা। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের কার্যক্রম পর্যালোচনার দাবিও উঠেছে। এমন অবস্থায় চাপে পড়েছে এ শিক্ষাব্যবস্থা। গত রবিবার হেফাজতের কমিটি বিলুপ্তির কয়েক ঘণ্টা আগে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের সব ধরনের রাজনীতিমুক্ত রাখার ঘোষণা দেয় মাদ্রাসাগুলোর নীতিনির্ধারণী বোর্ড আল হাইআতুল উলয়া লিল জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ।নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতের বিক্ষোভে সহিংসতায় ১৮ জন নিহত হন। এর পর সারাদেশে হেফাজত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নামে মামলা হয়। ধরপাকড় শুরু হয় দেশব্যাপী। এ পর্যন্ত হেফাজতের সদ্যবিলুপ্ত কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির অন্তত দুই ডজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিলুপ্ত কমিটির শীর্ষস্থানীয় তিন নেতা আহমদ আবদুল কাদের, জোয়ায়েদ আল হাবীব ও মামুনুল হক। যুগ্ম মহাসচিব, সহকারী মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সম্পাদকীয় পর্যায়ের বহু নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কমিটিধরে ধরে সব নেতাকে গ্রেপ্তারের আশঙ্কা করছেন শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
গত ১৯ এপ্রিল রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে তার বাসায় গিয়ে দেখা করে হেফাজতের একটি প্রতিনিধি দল। এর পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন হেফাজত নেতারা। এর পরও গ্রেপ্তার কমেনি।ধরপাকড় বেড়ে যাওয়ায় হেফাজত থেকে পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েক নেতা। আরও অনেকে পদত্যাগের প্রস্তুতি নিয়েও রেখেছেন। গত ১১ এপ্রিল গ্রেপ্তার শুরু হওয়ার পর প্রথমে হেফাজতের চার নেতা পদত্যাগ করেন।
খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা জাফরুল্লাহ খান বলেন, যারা হেফাজত থেকে পদত্যাগ করেছেন, তারা কী কারণে করেছেন জানি না। তবে আমি চিন্তাভাবনার মধ্যে আছি। আমাকে ডাকেও না, আমি নিজেও যাই না। কী কারণে এমন হয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হেফাজতের বর্তমান কার্যক্রম যেন কেমন হয়ে গেছে। কর্মসূচি যা দেওয়া হয়, তা অতিরঞ্জিত বলে মনে হচ্ছে।
পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক জমিয়তের (কাসেমী) সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা নাজমুল হাসান বলেন, আমি তো সক্রিয় নই। আর ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা সমীচীন মনে করি না। এসব পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির উপদেষ্টা খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, আমি তো সংগঠনের কোনো দায়িত্বে নেই। আমার নাম তারা উপদেষ্টা হিসেবে রেখেছে। আমি কখনই হেফাজতের কোনো সভায় অংশ নেইনি। আমি নিজে যাই না, ওনারাও ডাকেন না।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর হেফাজতের ১৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটি প্রত্যাখ্যান করেন হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত আহমদ শফীর ছেলে আনাসপন্থিরা। তারা এতদিন চুপচাপ থাকলেও সম্প্রতি সরব হয়েছেন। ওইপন্থি আলেমদের অনেকে বিবৃতি দিয়ে হেফাজতের বর্তমান নেতাদের কর্মকা-ের নিন্দা জানাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম ব্যুরো ও হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটির পাঁচ সদস্যের চারজনেরই বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে। একমিটির প্রধান উপদেষ্টা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও আহ্বায়ক জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। আহ্বায়ক কমিটির প্রধান উপদেষ্টা শাহ মুহিববুল্লাহ বাবুনগরী ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদ্রাসার মহাপরিচালক। সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী মাখজানুল উলুম মাদ্রাসার মহাপরিচালক, সদস্য সালাউদ্দিন নানুপুরী ফটিকছড়ির নানুপুর ওবায়দীয়া মাদ্রাসার পরিচালক এবং অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী গাজীপুরের কাপাসিয়া দেওনার পীর সাহেব। সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব নাসির উদ্দিন মুনির বলেন, নতুন করে কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। সংগঠন থেকে বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করে হেফাজতকে ঢেলে সাজানো হবে