খেলাপি ঋণ আদায়ে টাস্কফোর্স গঠন করেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ;এমডি কামরুল ইসলাম চৌধুরী

 

হামিদ বিশ্বাস

বেসরকারি খাতের মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২৩ বছরে পদার্পণ করছে আজ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।

তিনি জানান, করোনা মহামারির মধ্যেও প্রায় সব সূচকে ভালো করেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় প্রত্যেক ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এর অংশ হিসাবে মার্কেন্টাইল ব্যাংকেও মন্দ ঋণ আদায়ে পৃথক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক খাত সংস্কার, করোনার চ্যালেঞ্জ, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- হামিদ বিশ্বাস

যুগান্তর : মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলুন।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : নতুন নতুন সংকট মোকাবিলা করেও ১৯৯৯ সালের ২ জুন তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংক হিসাবে যাত্রা শুরু করা মার্কেন্টাইল ব্যাংক গত বছর বেশিরভাগ সূচকে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করেছে।

আমানত বেড়ে গত ডিসেম্বর শেষে ২৫ হাজার ২৮২ কোটি টাকা হয়েছে। ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকায়। এই ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার আমদানি, ১৩ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার রফতানি ও তিন হাজার ৮৯ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে। মূলধন পর্যাপ্ততার হার ছিল ১৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। সব মিলিয়ে করোনার মধ্যেও গত বছর ৩৯৫ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা হয়েছে। নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২১৬ কোটি টাকা। যে কারণে ১০ শতাংশ নগদসহ শেয়ারহোল্ডারদের ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে।

যুগান্তর : মহামারির মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। নতুন কোনো অনলাইন সেবা চালু করেছেন?

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : গ্রাহকদের সর্বাধুনিক ব্যাংকিং সেবা দিতে মার্কেন্টাইল ব্যাংক তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিয়মিত বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। ব্যাংকের ব্যয় ও ঝুঁকি কমাতে এবং গ্রাহকদের উন্নত সেবা দিতে বেশ আগেই সব শাখার কার্যক্রম কম্পিউটারাইজড করা হয়েছে। গ্রাহকদের রিয়েল টাইম অনলাইন সুবিধা দিতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার টেমোনস টি-২৪ এর সর্বশেষ ভার্সন আর-১৯ আপগ্রেডেশনের কাজ চলছে। যুগোপযোগী এবং উন্নত গ্রাহক সেবা দিতে মোবাইল অ্যাপ ‘এমবিএল রেইনবো’ চালু করা হয়েছে। আজ নতুন এ সেবার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে।

এর মাধ্যমে গ্রাহকরা ঘরে বসেই ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ক্রেডিট কার্ডের বিল, মোবাইল রিচার্জ, তহবিল স্থানান্তরসহ প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন। মাইক্যাশ নামে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবা ইতোমধ্যে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। এছাড়া গ্রাহকদের নগদ উত্তোলন ও জমা সহজ করতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১৮৬টি এটিএম বুথ এবং ২০টি ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন স্থাপন করেছি।

যুগান্তর : নতুনত্ব আনতে আর কোনো বিশেষ সেবা রয়েছে?

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ১৫০টি শাখা রয়েছে। গ্রাহকদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনা করে সম্প্রতি পাঁচটি উপশাখা খোলা হয়েছে। ২০২০ সালে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ও ইসলামী ব্যাংকিং সেবা চালু করা হয়। ইতোমধ্যে ১০৮টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ও ৪৫টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছর চারটি নতুন শাখা ও ১৫টি উপশাখা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ক্রমান্বয়ে সব শাখায় সাধারণ ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিং সেবা চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

যুগান্তর : ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোন খাতে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন?

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছি। লক্ষ্য হচ্ছে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। একইসঙ্গে ঋণ বহুমুখী করার মাধ্যমে ঝুঁকি তথা খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো। বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। রপ্তানি এবং দেশীয় শিল্পের বিকাশে ব্যবসায়ীবান্ধব বিভিন্ন ঋণ সুবিধা চলমান রয়েছে।

যুগান্তর : করোনায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা কর্মীদের জন্য কোনো প্রণোদনা দিয়েছেন?

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : করোনাকালে ব্যাংকের কর্মীরা গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিচ্ছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কর্মীদের নিয়মিত বেতন, উৎসব বোনাস, প্রফিট বোনাস, ইনক্রিমেন্ট, বৈশাখী ভাতা, প্রমোশনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রেখেছে। কর্মীদের কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে বিশেষ যত্ন নেওয়া, নিজস্ব চিকিৎসকের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা ও চিকিৎসা ভাতা দেওয়া হয়েছে।

যুগান্তর : শিক্ষাবৃত্তিসহ সিএসআর কার্যক্রম বিষয়ে কিছু বলুন।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফাউন্ডেশন থেকে সামাজিক কল্যাণ ও দারিদ্র্য বিমোচন, গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সুদবিহীন শিক্ষাঋণ সুবিধা এবং উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। ২০২০ সালে সিএসআর খাতে ব্যাংক ৩০ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। ২০১১ সাল থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসাবে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের ‘মার্কেন্টাইল ব্যাংক আব্দুল জলিল শিক্ষাবৃত্তি’ দেওয়া হচ্ছে।

যুগান্তর : ব্যাংক খাতে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : ব্যাংক খাতে বিদ্যমান সংকট নিরসনে প্রশাসনিক ও আইনি সংস্কারের পাশাপাশি আদর্শ ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার সম্প্রতি ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ সংশোধনে করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রত্যেক ব্যাংক পৃথক টাস্কফোর্স গঠন করেছে।

যুগান্তর : ব্যাংক খাতের অন্যতম সমস্যা খেলাপি ঋণ। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এ ক্ষেত্রে কী অবস্থা?

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : সুশাসন এবং নীতি-নৈতিকতার অভাবে ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অভ্যাসগত বা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এতে করে মন্দ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এই দিক দিয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অবস্থা সন্তোষজনক। সম্পদের গুণগতমান বৃদ্ধিতে ঋণের নজরদারি জোরদার করায় শ্রেণিকৃত ঋণের হার কমে ৪ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে এসেছে।

যুগান্তর : করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যাংকগুলো কতটা প্রস্তুত?

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : করোনা সংকট থেকে ব্যাংকিং খাত উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানামুখী উদ্যোগ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। করোনার অপ্রত্যাশিত ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা অনেক নতুন কলাকৌশল আয়ত্ত করে নিয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নিজেদের ভূমিকাকে আরও গতিশীল করে তুলতে হবে।

যুগান্তর : আগামী অর্থবছরের কেমন বাজেট চান?

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজন। এছাড়া বিগত বছরগুলোর তুলনায় কৃষি খাতের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বর্তমান সংকটে সামনের দিনগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তায় একটি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। সামাজিক সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক খাতের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার পদক্ষেপ নিতে হবে। এই সব খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

যুগান্তর : ব্যাংকিং পেশায় চ্যালেঞ্জ কোথায়?

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : ব্যাংকিং পেশা সুন্দর ও ভালো পেশা। তবে অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ এর পেছনে রয়েছে ধৈর্য এবং কঠোর পরিশ্রম। তারপরও এই সেক্টরে চাকরির চাহিদা অনেক বেশি। কারণ ব্যাংকের চাকরি কঠিন হলেও এখানে অনেক প্রাপ্তিও রয়েছে।

যুগান্তর : ধন্যবাদ।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী : আপনাকেও ধন্যবাদ।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ