প্রবল ঝড় -ঝঞ্ঝা। উত্তাল বঙ্গোপসাগর। এমন বৈরী আবহাওয়ায়ও ম্যাকলিন কোম্পানি জাহাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। দুর্যোগের হুঁশিয়ারিতেও জাহাজ কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করলো না। বরং তারা বললো, আমাদের জাহাজ অনেক বেশি শক্তিশালী। এ ধরণের ঝড় মোকাবেলা করতে সক্ষম আমাদের ক্যাপ্টেন। তাদের কথা বিশ্বাস করলো ৭৫০ জন যাত্রী, যাদের বেশিরভাগই নারী।
২৫ মে, ১৮৮৭ সাল; যাত্রা শুরু করলো ব্রিটিশ জাহাজ ‘স্যার জন লরেন্স’। বঙ্গোপসাগরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কয়লাঘাট থেকে রাতের বেলা রওনা দিলো জাহাজ। এরপর কয়েকঘণ্টা পরই ঘটলো মর্মান্তিক ঘটনা। তার আগে জানা প্রয়োজন এই ৭৫০ জন যাত্রী কোথায় যাচ্ছিলেন?
পশ্চিমবঙ্গ ও এর আশেপাশের মানুষের কাছে পুরী বেশ আকর্ষণীয় জায়গা। বাংলাদেশের অনেক মানুষও সেখানে ঘুরতে যান। তবে একসময় এটি শুধু মন্দির দর্শনের জন্য বিখ্যাত ছিল। বছরে অন্তত একবার পুরীতে জগন্নাথ দর্শন অনেকের কাছে বাধ্যতামূলক ছিল। আর তখন পুরী যেতে হতো বালেশ্বর হয়ে।
ভারতের ওড়িশা রাজ্যের বালেশ্বরে যেতে হলে তখন সমুদ্র পথই ভরসা ছিল। আর সেখান থেকে ফের নৌপথে সমুদ্রপথে হয়ে পালকি-ডুলিতে জগন্নাথ দর্শনে যেতে হতো পুরী। কারণ রাস্তাজুড়ে তখনও রেলগাড়িতে যাওয়ার রেওয়াজ তৈরি হয়নি। আর তাই পূণ্যের আশায় যাত্রীদের সমুদ্রপথে বালেশ্বর নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবহণের ব্যবসা ফেঁদে বসলো কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি। তাদেরই একটি হল ‘ম্যাকলিন অ্যান্ড কোম্পানি’।
খবরের কাগজে তারা ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করতো তাদের জাহাজের কথা। কাঙ্খিত পুণ্যের ইচ্ছেপূরণ তারাই যে সহজে করতে পারবে, তারা তা বুঝিয়ে দিতেন শব্দের মায়াজালে। আর তাতে সহজ-সরল মানুষরাও উঠেপড়ে ‘বাষ্প জাহাজ’-এর টিকিট কাটতেন।
যাহোক, জাহাজ ঠিক সময়ে ছাড়লেও প্রত্যাশিত ফেরার দিনে জাহাজ ফেরেনি। দিন যায়, অথচ জাহাজ ফেরে না। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। জাহাজ কোম্পানি ক্যাপ্টেন আরভিং-এর সাহসিকতার প্রচার করে জানায়, এমন ক্যাপ্টেন যে জাহাজের সেটা তো ফিরবেই। সে নাকি এক যুগ আগেই ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করা সৈনিক।
২৭ মে, টেলিগ্রাম এলো চাঁদবালীর স্টিমার অফিস থেকে। সেটাতে লেখা হল ‘স্যার জন লরেন্স’ এখনও সেখানে নোঙর করেনি। ম্যাকালিন কোম্পানি তাতেও কান না দিয়ে জন লরেন্স জাহাজের পরবর্তী যাত্রার বিজ্ঞাপন দিয়ে দিল। ভাবটা এমন, যেন কিছুই হয়নি। এভাবে কেটে গেল আরও কয়েকদিন। কিন্তু ৮ দিন পর, অর্থাৎ ২ জুন ইংলিশম্যান পত্রিকা যে খবর প্রকাশ করলো, তাতে বোঝা গেল সব শেষ। ‘রেসলিউট’ নামের একটি জাহাজ কলকাতায় ফেরার পথে সাগর মোহানায় দেখতে পেয়েছে লাশে সারি সমুদ্রে ভাসছে।
তোলপাড় শুরু হলো কলকাতায়। রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখলেন ‘সিন্ধুতরঙ্গ।’ খামখেয়ালিপনার এমন পরিণতির লজ্জা ইংরেজ রমণীদেরও বিচলিত করলো। হাজার হোক তারা কলকাতাতেই তো থাকেন। ওদিকে জাহাজ কোম্পানির শোকপ্রকাশ দূরে থাক, চলল আবার বিজ্ঞাপন। আর তখন একদল ইংরেজ রমণীরা জাহাজের যাত্রীদের স্মরণে একটি ফলক স্থাপন করেছে। তাতে লেখা –“This stone is dedicated by a few English-women to the memory of those pilgrims, mostly women, who perished with ‘Sir John Lawrence’ in the cyclone of 25th May 1887.”
সেই পাথর আবছা হয়েছে, রঙের ছোপে পাথর থেকে ঢাকতে চলেছে। কিন্তু কলকাতা আজও বুকে ধরে রেখেছে এই কান্না ভেজা পাথরটিকে।