আলী রিয়াজ
দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা ব্যবসা করলেও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরম থেকে পর্যাপ্ত কর পাচ্ছে না সরকার। ইন্টারনেটভিত্তিক ইউটিউব, ফেসবুক, গুগল, ইয়াহুসহ আরও একাধিক মাধ্যম বিজ্ঞাপন প্রচার করে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। যে আয়ের পুরো টাকাই চলে যাচ্ছে বিদেশে। এদিকে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এসব সামাজিক মাধ্যম বাংলাদেশ সরকার ও রাষ্ট্র বিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য ও কনটেন্ট প্রচার করছে। বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধ করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাইলেও প্রতিষ্ঠানগুলো তা দিচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশ সরকারবিরোধী প্রচারণাও অপসারণ করছে না। জানা গেছে, অনলাইন বিজ্ঞাপনের নামে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার বেশি নিয়ে যাচ্ছে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম। দেশে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়াও বিলের ওপর ৪ শতাংশ কর কাটা হয়। কিন্তু বিদেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্বীকৃত কোনো অফিস কিংবা লেনদেনের বৈধ মাধ্যম না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কর আদায় কিংবা হুন্ডি প্রতিরোধ কঠিন হচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার হচ্ছে অনেক সময় বিজ্ঞাপন ও বুস্টিংয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য তাদের অনুমোদন নিতে হয় না। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো এজেন্ট বিজ্ঞাপনের ব্যয় পরিশোধের জন্য টাকা পাঠাতে চাইলে এ অনুমোদন লাগে। ‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ এ অনুমোদন দেয়। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধনের শুরু থেকেই যেখানে কর গুনতে হয় বিদেশি এসব প্রতিষ্ঠানকে তার কিছ্ ুকরতে হয় না। এ ছাড়া বিদেশি ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যমের কারণে বিজ্ঞাপন হারাচ্ছে স্থানীয় গণমাধ্যম। সম্প্রতি বিশ্বের কয়েকটি দেশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর করারোপ করেছে। বৈশ্বিক বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন কর আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে এসব বিদেশি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট না থাকায় কোনোভাবেই কর আদায় করা যাচ্ছে না। ঢাকায় অফিস করতে তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফেসবুক, গুগল, ইয়াহু, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা কার্যক্রম চালাচ্ছে। গত কয়েক বছরে এ মাধ্যমে যোগ হয়েছে টিকটক, ইমোসহ অ্যাপসভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম। এসব প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় কার্যালয় না থাকায় দেশের প্রচলিত আইনে তাদের থেকে কোনো ধরনের ট্যাক্স, ভ্যাট ও রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। উল্টো হুন্ডিসহ আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ পাচার অব্যাহত রেখেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। এতে একদিকে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারও হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব। এদিকে রাষ্ট্রবিরোধী ও স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে কনটেন্ট সরাতে বললেও তারা কানে তুলছে না। সরকার ও রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতা চালাতে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যম। আইনি কাঠামো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হিমশিম খাচ্ছে। ফেসবুকসহ ইন্টারনেট জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা যে দেশে ব্যবসা করে সেখানে যথাযথভাবে কর পরিশোধ করে না।
সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের বিজ্ঞাপন বাজারের ২০ শতাংশই গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফরমগুলো নিয়ে যাচ্ছে এবং তা প্রতিদিনই বাড়ছে। এ ধরনের প্ল্যাটফরম থেকে রাজস্ব আদায়ের প্রশ্ন নিয়ে হাই কোর্টে হুমায়ুন কবির নামে একজন আইনজীবীর রিট আবেদনে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়ে ভ্যাট না দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর অব্যবস্থাপনা বড় সমস্যা। এ ছাড়া অ্যামাজনের মতো ইন্টারনেটভিত্তিক কেনাকাটার প্ল্যাটফরমগুলো থেকেও ভ্যাট আদায় করা যাচ্ছে না। এ প্ল্যাটফরমগুলোর বাংলাদেশে লেনদেনের বিষয়ে মনিটরিংয়ের ঘাটতি রয়েছে। এতে দেখা গেছে, বেশির ভাগই ইন্টারন্যাশনাল কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্ট হচ্ছে। এটা ট্র্যাক করা খুবই কঠিন। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পেমেন্ট হচ্ছে, কিন্তু এর বিস্তারিত জানার ক্ষেত্রে আমাদের যে ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি দরকার তা নেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো কিন্তু গুগল, ফেসবুককে অনেক টাকা পরিশোধ করে প্রতি বছর। সেখান থেকে কতটা ভ্যাট ও শুল্ক বাংলাদেশ পায় তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। ওই রিট আবেদনে হাই কোর্ট সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে রাজস্ব আদায়ের নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর করা যায়নি। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ প্ল্যাটফরমগুলোর ঢাকায় কোনো অফিস না থাকায় ভ্যাট বা শুল্ক আদায় করা যাচ্ছে না। সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমাদের দেশের রেডিও, টেলিভিশন বা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হলে ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু সামাজিক মাধ্যম গুগল কিংবা ফেসবুক বা অন্যরা বাংলাদেশ থেকে বিজ্ঞাপন নেয়, তারা ভ্যাট প্রদান করে না। এটা আমাদের আইনের বিরোধী।’