আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক খাতে পড়বে

আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক খাতে পড়বে

 

  • নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনভাইরাসে সৃষ্ট মহামারীর প্রভাব আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক খাতে পড়বে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আগাম পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, শুধু চলতি অর্থবছর নয়, আগামী ২০২৩-২৪ সাল পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি খুব বেশি বাড়বে না। বর্তমান অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের সংশোধিত প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সেটা ধরা হয়েছে ১২ শতাংশ। সেখানে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ শিল্পে পণ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কাটছাঁট করা হয়েছে। একই কারণে ২০২০ সাল থেকেই সংকটে চলছে দেশের রপ্তানিতে বড় অবদান রাখা তৈরি পোশাক খাতে। করোনার প্রভাব মোকাবিলায় যদিও চারটি প্যাকেজের আওতায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার সহায়তা দেওয়া হয়েছে রপ্তানিমুখী এই শিল্প খাতকে। সরকার কোভিড-১৯-এর প্রভাব থেকে রপ্তানি খাতের উত্তরণে ‘কাউন্টারসাইক্লিক্যাল’ ব্যবস্থা হিসেবে আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।  এদিকে চলতি অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে এসে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ কমিয়ে ১২ শতাংশ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর ফলে ধারণা করা হচ্ছে, আগের বছরের চেয়ে রপ্তানি কমবে ৩৬ হাজার কোটি টাকা (৪২৫ কোটি মার্কিন ডলার)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনার প্রভাব মোকাবিলায় গত বছর আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য প্রথমে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এই তহবিল বেড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাত উদ্যোক্তাদের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকার মূলধনী ঋণ সুবিধা এবং রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড ১৭ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়। পাশাপাশি প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট ফাইন্যান্সিং প্রকল্পে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, রপ্তানি খাত উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের তহবিল গঠন ছাড়াও সরকার নানা ধরনের কৌশল নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-রপ্তানি বহুমুখীকরণ, নতুন বাজার অনুসন্ধান, নতুন নতুন মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন ও রপ্তানি খাতের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, জ্বালানি, বন্দর ও যোগাযোগ অবকাঠামোসহ সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যা নিরসন অন্যতম।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান বলেন, গার্মেন্ট মালিক ও কারখানার শ্রমিক এবং সরকারের প্রচেষ্টায় তৈরি পোশাক খাত এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তবে করোনার কারণে রপ্তানিমুখী এই খাত ঘুরে দাঁড়াতেই পাচ্ছে না। এ পর্যন্ত করোনায় তিন হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি অর্ডার বাতিল হয়েছে বলে তিনি জানান। বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট বলেন, রপ্তানি অর্ডার বাতিল হওয়ার পরও ফ্যাক্টরি খোলা রেখে ব্রেক ইভেন্ট মূল্যে পণ্য বিক্রি করছি। তবে তিনি আশা করছেন, চলতি অর্থবছরে গার্মেন্ট শিল্পে তিন হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের আয় হবে। তার মতে, করোনায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। তিনি করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি ধরে রাখতে প্রণোদনার হার ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার দাবি জানান।

তৈরি পোশাক খাতকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বন্ডের কার্যক্রম সহজ করার দাবি জানিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। তারা করোনাজনিত কারণে ঋণ শ্রেণিকরণের সময়সীমা বৃদ্ধি করারও দাবি জানান।

জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল চার হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের আয় ছিল তিন হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। এই হিসাবে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে চলতি অর্থবছরে। কিন্তু এখন সেটি কমিয়ে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি’র তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই (২০২০) থেকে মে (২০২১) পর্যন্ত্ত এই ১১ মাসে আয় হয়েছে তিন হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। বাকি এক মাসে অবশিষ্ট ৫৮২ কোটি ডলার অর্জন করা কোনোভাবেই  সম্ভব নয়।

চলমান মহামারীর কারণে বিশ্ববাণিজ্য এবং পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার হিসাবে ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকের বাজার ছিল ৪৮ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানে ২০১৯ সালে কমে ৪১ হাজার ৯০০ ডলারে নেমেছে। ২০২০ সালে বাজার আরও কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এরই একটি ধাক্কা এসেছে দেশের রপ্তানি খাতের ওপরে। ইপিবি’র হিসাবে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে চামড়া খাতের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমছে ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন রপ্তানি পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হলেও আগামী বছর থেকেই পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কথা। কারণ বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। চীনের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি আবারো ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতও ঘুরে দাঁড়ানোর কথা। তবে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের টিকে থাকতে হবে আগে। পণ্যের মান ও দাম যে-কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

এক্ষেত্রে করোনা মহামারী খুব বেশি ভূমিকা রাখছে না বলে জানান তিনি। এর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মহামারী করোনার মধ্যেও গার্মেন্ট খাতের উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে। অর্ডারও বাড়ছে। ফলে রপ্তানি খাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

উদ্যোক্তারা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পোশাক শিল্প সংক্রান্ত ইস্যুগুলো সহজীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা এই শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে।

তারা তৈরি পোশাক শিল্প খাতে ১৩৩টি রুগ্ণ শিল্পের পুনর্বাসনে নীতিগত সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুরোধ জানান।

অর্থ বাণিজ্য