হামিদ বিশ্বাস
ব্যাংক খাতে খেলাপির সঙ্গে বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতিও। চলতি বছরের মার্চ শেষে ঋণমানের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি ১১ ব্যাংক। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি, বেসরকারি ৬টি ও ১টি বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৬৪৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেওয়ায় আদায় হচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন ছাড়ের কারণে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে খেলাপি বাড়ায় প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে। যারা প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের আবার মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা। ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। আবার অনেকের বিশেষ সুবিধার আশায় ইচ্ছা করে ঋণের কিস্তি দিচ্ছে না। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারেনি। যার কারণে ঘাটতি বেড়েছে।
তিনি বলেন, ঋণের ঝুঁকি কমাতে হলে আদায় বাড়াতে হবে। যাচাই-বাছাই করে সঠিক নিয়মে ঋণ দিতে হবে। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোর বিষয়ে নজর দিতে হবে। ঋণ আদায়ের জোর দিতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। এখন ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য আছে এ অর্থ সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি, বেসরকারি, বিদেশিসহ সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, সেসব গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসাবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দমানে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক ও গ্রাহক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ পর্যন্ত ১১ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১২ হাজার ৬৪৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা, বেসরকারি ছয় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি এক হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত এক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৬৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। তবে কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসাবে রাখায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৬৮ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬২ হাজার ৮০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে মোট নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার ২৫৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশিরভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশনিং। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের (এসএমই) বিপরীতে সবচেয়ে কম দশমিক ২৫ শতাংশ আর ক্রেডিট কার্ডে রাখতে হয় সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি।
এছাড়া নিুমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে প্রভিশনিং করা হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে এতে ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডাদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।
এদিকে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বিশেষ সুযোগ নিয়ে বছরজুড়ে কিস্তি না দিয়েও যে সব ঋণ খেলাপি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, ওই সব ঋণের বিপরীতে এখন অতিরিক্ত ১ শতাংশ প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে ডিসেম্বরে একটি নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘স্পেশাল জেনারেল প্রভিশন কোভিড-১৯’ নামের এ প্রভিশনে স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন ধরনের ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। এখন তার সঙ্গে আরও ১ শতাংশ অতিরিক্ত রাখতে বলা হয়েছে।
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপির অঙ্ক ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে খেলাপি বেড়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।