কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির জমি ক্রয়ে ৮৭ কোটি টাকা লোপাট

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম  কেজিডিসিএলের (কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড) অবৈধ পন্থায় জমি ক্রয় খাতে ৮৭ কোটি টাকা সরকারী অর্থ আত্মসাতের ঘটনা অনুসন্ধান শেষ করেছে দুদক। মামলার জন্য এটি এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে দীর্ঘ প্রায় এক বছর। উল্লেখ্য, কেজিডিসিএল পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন ১৩টি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের একটি। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির কেজিডিসিএল কেনার খাতে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে জমি অধিগ্রহণের ছদ্মাবরণে সরকারী অর্থ লোপাটে নির্ধারিত মৌজা মূল্য এমনকি বাজার মূল্যের তিন গুণ বেশি দাম নির্ধারিত করে প্রায় ২৮ কাঠা জমি ৬ কোটি ৭২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা হলেও দেখানো হয়েছে ৯৩ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬৮০ টাকা। এ জমি ক্রয় প্রক্রিয়ায় সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিংবা বোর্ড বা মন্ত্রণালয়ের কিংবা একনেকের আর্থিক অনুমোদন ব্যতিরেকে সম্পাদন করা হয়েছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে উক্ত পরিমাণ অর্থ কয়েক কর্মকর্তা যোগসাজশে লোপাট হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সংস্থার ব্যবস্থাপক (আইন), কোম্পানি সেক্রেটারিয়েট সদস্য, সংশ্লিষ্ট কমিটি ও সহকারী ব্যবস্থাপক (এস্টেট), পরিকল্পনা ডিপার্টমেন্টসহ (সচিব) আরও কয়েকজন। অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, ক্রয় প্রক্রিয়া যথাযথ হয়েছে কিনা এবং দরদাতার দর সঠিক আছে কিনা তা পুনঃযাচাইয়ের জন্য সংস্থার উপব্যবস্থাপক মোঃ লুৎফুল করিম চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও মোঃ নুরুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সার্বিক বিবেচনায় জমি ক্রয়ের জন্য গৃহীত প্রক্রিয়া এবং প্রস্তাবিত জমি ধার্যকৃত মূল্যে যথাযথ আছে বলে উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়ে সার্চ কমিটি তাদের মতামত দেয়। সংস্থার স্বার্থে অফিস ভবন নির্মাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জমি ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রকৌশলী মোঃ আনিছ আহমেদ ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর টাকা পরিশোধ সংক্রান্তে কোম্পানির গেইন ট্যাক্স বাবদ ৩ কোটি ৯০ লাখ ৭৩ হাজার ৩২০ টাকা পরিশোধ করে জমির অবশিষ্ট মূল্য বাবদ ৯৩ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬৮০ টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়ার এই নোটিংয়ে কর্মকর্তা ফিরোজ খান অনুমোদনকারী হিসেবে পাস করেন। ওই সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোঃ আইয়ুব খান চৌধুরীর আর্থিক অনুমোদন কিংবা বোর্ডের, অথবা মন্ত্রণালয়ের, অথবা একনেকের অনুমোদন ব্যতিরেকে কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর ও মোঃ ফিরোজ খান অনুমোদনকারী হিসেবে হাজী ইউনুস আহমেদ নামে একটি কোম্পানিকে উক্ত পরিমাণ টাকা পরিশোধ করেন, যা কোম্পানির বোর্ড কিংবা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের এখতিয়ার বহির্ভূত। নিয়ম অনুযায়ী ৫০ কোটি টাকার উর্ধে ক্রয়ের আর্থিক ক্ষমতা একমাত্র একনেকে। তদুপরি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী বেসরকারী জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তিনগুণ দাম নির্ধারণ জেলা প্রশাসকের এল এ ডিপার্টমেন্টের ওপর বর্তায়। এ ঘটনায় কেজিডিসিএলের উল্লেখিত অভিযুক্তরা এবং এর সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র উক্ত পরিমাণ সরকারী অর্থ লোপাট করে নিয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে কেজিডিসিএলের প্রকৌশলী আনিছ আহমেদ মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ডিভিশন, বর্তমানে পিআরএলএ থাকা), ব্যবস্থাপক (আইন) কবির আহমেদ, সহকারী ব্যবস্থাপক (এস্টেট) মোঃ আবুল কালাম, জমি বিক্রয় যাচাই সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মোঃ শফিউল আজম খান, জমি ক্রয় প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্য লুৎফুল করিম চৌধুরী, সার্চ কমিটির সদস্য সচিব মোঃ নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এজেএম ছালেহ উদ্দিন সারওয়ার, জাহাঙ্গীর হোসেন, মোঃ ফিরোজ খান, উক্ত পরিমাণ অর্থ লোপাটের সঙ্গে জড়িত হয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়ম ও ঘাপলা ॥ কেজিডিসিএল কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য তিনটি কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। মূল্যায়ন কমিটির নিকট উপস্থাপনের জন্য রেটিং শিট এবং পদ পদোন্নতির অনুমোদন অবশ্যই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। সূত্র জানায়, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) হলেন প্রশাসন ডিভিশনের মূল কর্মকর্তা। প্রশাসন ডিভিশনের মূল দায়িত্ব হলো পদোন্নতির জন্য যোগ্য কর্মকর্তাদের রেটিং শিট প্রস্তুতকরণ, বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তিকরণ, আদালতে কোন মামলা চলমানরত রয়েছে কিনা, দুদকে কোন অভিযোগ বা মামলা রয়েছে কিনা, প্রাপ্তিদের মূল নথি যাচাই-বাছাই, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, দুদকের ছাড়পত্র, এসিআর সঠিক রয়েছে কিনা তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মূল্যায়ন শেষে কমিটির নিকট উপস্থাপন করা।

এক্ষেত্রে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংস্থার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) প্রকৌশলী খায়েজ আহমদ মজুমদার। তিনি মন্তব্যে উল্লেখ করেছেন, ‘পদোন্নতির জন্য প্রস্তাবিত কর্মকর্তাদের তালিকা (রেটিং শিটসহ) নির্দেশনামতে আমাকে না দেখিয়ে বা অবহিত না করে কমিটির নিকট উপস্থাপন করা হয়েছে, যা মোটেই সঠিক হয়নি। যাই হোক দুদকের ছাড়পত্র, দুদকের সম্মতিসহ চাকরি প্রবিধানমালা, পদোন্নতি নীতিমালা অনুযায়ী সবকিছু যথাযথ থাকলে কমিটির সুপারিশমতে ব্যবস্থা নেয়া যায়।’ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উক্ত নোটিং উপেক্ষা করে কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ, লুৎফুল করিম চৌধুরী ও প্রকৌশলী মোঃ সারওয়ার হোসেনের দ্বারা পদোন্নতির অফিস জারি করানো হয়। এমনকি নথি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিকট পুনরায় উপস্থাপন না করে অফিস আদেশের জন্য কয়েক কর্মকর্তা দিয়ে অনুমোদন করানো হয়, যা প্রতারণাপূর্বক ক্ষমতার অপব্যবহারের শামিল।

সূত্র জানায়, একইভাবে ২০১১ সালের সহকারী ব্যবস্থাপক (সাধারণ) পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের মূল নথি গায়েব ও ৩৭ জনের নিয়োগ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান চলমান অবস্থায় ২৪ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এতে দুদকের কোন ছাড়পত্র নেয়া হয়নি। এ কাজে সংস্থার একটি সংঘবদ্ধ জড়িত রয়েছে।

Others অপরাধ শীর্ষ সংবাদ সারাদেশ