চট্টগ্রামে ঘটক ও পাত্রী সেজে অসংখ্য মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার অভিযোগে এক নারী ও একজন পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল ভোরে চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার (রাউজান রাঙ্গুনিয়া সার্কেল) মো. আনোয়ার হোসেন শামীম’র নেতৃত্বে জেলার রাউজান উপজেলাধীন গচ্ছি নয়া হাট এলাকায় ঝটিকা অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাউজান উপজেলার গচ্ছি নিবাসী মৃত মাওলানা মো. হারুন-এর ছেলে ওকার উদ্দিন ওরফে আরিফ (৩৬) এবং তার স্ত্রী সেলিনা আক্তার ওরফে শিরিন আক্তার ওরফে শেলি (৩২)সহ একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে টার্গেট করে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করানোর প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল।
একজন প্রবাসী ভুক্তভোগী এই চক্রের কাছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা হারানোর পর গত ১৬ জুন এ বিষয়ে রাউজান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
সে অনুযায়ী গতকাল ভোরে অভিযুক্ত চক্রের মূল হোতা স্বামী-স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মধ্যরাত হতে ভোর পর্যন্ত টানা এ পুলিশি অভিযানে মোবাইল ডিভাইসসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান চালিয়ে তাদের বিপুল প্রতারণার তথ্যপ্রমাণও সংগ্রহ করা হয়। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন এসআই শাহাদাত এবং এসআই অনুপমসহ রাউজান থানা পুলিশের একটি টিম।
গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই নিজেদের প্রতারণার কথা স্বীকার করে নেয়। এসময় উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা তাদের প্রতারণার অভিনব কৌশলের কথাও প্রকাশ করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে স্বামী ওকার উদ্দিন তার এক সহযোগীকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ডিভোর্সড বা স্ত্রী মারা গেছে এমন বিত্তশালী মানুষ, বিশেষ করে বিদেশ ফেরত ও ধনাঢ্য মধ্যবয়সী ব্যক্তিদের টার্গেট করতেন।
তারপর কৌশলে তাদের সাথে পরিচিত হয়ে ঘনিষ্টতার একপর্যায়ে টার্গেট ব্যক্তিদেরকে জানাতেন যে, তাদের হাতে সুন্দরী ও বড়লোক বাবার মেয়ে পাত্রীর সন্ধান রয়েছে এবং চাইলে তারা পাত্রী দেখানো এবং বিয়ের উদ্যোগ নিতে পারেন। টার্গেট রাজি হলে প্রতারকরা তাদেরকে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে গিয়ে বেশকিছু পাত্রী দেখাতেন এবং কৌশলে জেনে নিতেন কোন পাত্রীকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই টার্গেটের মোবাইলে সেই পছন্দকৃত পাত্রীর পরিচয় দিয়ে কল করতেন প্রতারক চক্রের সদস্য সেলিনা (ওকার উদ্দিনের স্ত্রী)। দুয়েকদিন অন্তরঙ্গ কথা চালিয়ে যাওয়ার পর বলতেন, তিনি তার মায়ের মোবাইল থেকে কথা বলেন, তাই সবসময় কথা বলা সম্ভব হয় না এবং জরুরিভিত্তিতে তার একটি মোবাইল ফোন কেনা প্রয়োজন। কয়েকদিন পর বলতেন যে, তিনি অসুস্থ, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, বিভিন্ন ব্যয়বহুল টেস্ট করতে হবে, টাকা দরকার।
এভাবে বিভিন্ন অজুহাতে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দুজনের অন্তরঙ্গ আলাপ রেকর্ডও করে রাখা হতো। অনেকবার এভাবে টাকা দেওয়ার পর ভিকটিমরা যখন বুঝতে পারতেন যে, তিনি প্রতারিত হয়েছেন, তখন তাদেরকে হুমকি দেওয়া হত যে, যদি তারা এই বিষয়ে পুলিশ কিংবা অন্য কাউকে কিছু বলে, তাহলে তার আত্মীয়স্বজনের কাছে রেকর্ডকৃত অন্তরঙ্গ কথোপকথন পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য তারা মোবাইল কলের বদলে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে যাবতীয় যোগাযোগ ও আলাপচারিতা সম্পন্ন করতেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রতারক চক্রের মূল হোতা ওকার উদ্দিন নিজেও ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দিন দুবাই প্রবাসী ছিলেন। কিন্তু তাতেও ভাগ্য ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৪ তে দেশে ফিরে চট্টগ্রামের বোয়ালখালির মেয়ে সেলিনা আক্তারকে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী এবং অন্য কয়েকজন সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন অভিনব এই প্রতারণার ফাঁদ।
এ প্রসঙ্গে অভিযানের নেতৃত্বে থাকা চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আনোয়ার হোসেন শামীম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এই চক্রটির গতিবিধি মনিটর করে আসছিলাম। সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি মামলা হওয়ার পর গতকাল রাতে অভিযান চালিয়ে আমরা অভিযুক্ত স্বামী-স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করি। এই চক্রে জড়িত অন্যদেরও শিগগিরই আইনের আওতায় আনা হবে।