পল্লবীতে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। অতি সম্প্রতি শিশু সন্তানের সামনে পিতা শাহিনুদ্দিন হত্যার স্বীকার হয় সুমন বাহিনীর হাতে। সুমনের রয়েছে নিজস্ব কিশোর গ্যাং। সুমন গ্রেফতার হলেও তার বাহিনী এখনও পল্লবী চষে বেড়াচ্ছে।
শুধু সুমন নয় পুলিশের নিজস্ব গোয়েন্দা শাখা কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তালিকা অনুযায়ী পল্লবীতে রয়েছে সর্বমোট ৫টি ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং বাহিনী। তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ৫টি গ্রুপের মাঝে রয়েছে সুজন-রাসেল গ্রুপ, সুমন গ্রুপ, বিপ্লব গ্রুপ, সাগর গ্রুপ ও জয় গ্রুপ।
পল্লবীর সাবেক ওসি কাজী ওয়াজেদ আলীর স্বোচ্ছাচারিতায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল এই কিশোর গ্যাং গুলো। তখন কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে কেউ মামলা দিতে গেলে মামলা না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেই সাথে মামলা হওয়ার পর প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়ালেও গ্রেফতার করতে দেখা যায়নি এদের কাউকে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ শাহিনুদ্দিন হত্যাকান্ড। শাহিনুদ্দিনকে গত বছর নভেম্বরে সুমন বাহিনী হত্যার উদ্দেশ্যে ভয়াবহ হামলা চালায়। কিন্তু, ওসি ওয়াজেদ সুমনসহ মামলার কোন আসামীকেই গ্রেফতার করেনি। বরং, বরাবরই আশ্রয় দিয়েছে। শাহিনুদ্দিন হত্যার আগে আলীনগরের সামনে সুমন আবার শাহিনুদ্দিনের উপর হামলার চেষ্টা করে। এই সময় স্থানীয়দের সাহায্যে সুমনকে আটক করা হলেও, ওসি ওয়াজেদ নতুন মামলা না নিয়ে পুরোনো শাহিনুদ্দিন হত্যাচেষ্টা মামলায় আদালতে হাজিরা না দেওয়ায় ইস্যু হওয়া ওয়ারেন্টে আটক দেখায়। যাতে পরেরদিনই সুমন জাবিন পেয়ে যায়।
পরবর্তীতে শাহিনুদ্দিন ও তার ভাই মাইনুদ্দিনকে মিথ্যা মামলায় আটক করে জেলে পাঠায়। শাহিনুদ্দিন জাবিনে বের হলে, ২৭ রমজানের দিন শাহিনুদ্দিনের বাসায় বিশাল বাহিনী নিয়ে সুমন হামলা চালায়। তখনও শাহিনুদ্দিনের পরিবার থেকে মামলা করতে গেলেও তাদের মামলা নেওয়া হয়নি। সুমনও অধরা থেকে যায়। এই প্রেক্ষিতে স্থানীয়রা বলছে, ওসি ওয়াজেদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই শাহিনুদ্দিন হত্যাকান্ডের স্বীকার হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে ওসি কাজী ওয়াজেদকে শাস্তিমূলকভাবে ডিবি গুলশান জোনে বদলী করা হয়।
শুধু শাহিনুদ্দিই নয়, ওসি কাজী ওয়াজেদের সময় জয়, বিপ্লবসহ সকল বাহিনীর উত্থাণ ঘটে। যা পুলিশের নিজস্ব গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সুজন-রাসেল গ্রুপ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় সর্ব প্রথম সুজন রাসেল গ্রুপের নাম এসেছে। বায়নিবাধ, পলাশ নগর এলাকার আতঙ্ক এই গ্রুপের সদস্যরা। মাদক সেবন, দখল বাণিজ্য, চাঁদাবাজীসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে এই গ্রুপের বিরুদ্ধে। পলাশ নগরে একটি বাড়ী দখল করতে গিয়ে গুলি ফোটানোরও অভিযোগে আদালতে মামলা হয় এই গ্রুপের বিরুদ্ধে। বাদী থানায় গিয়ে মামলা রেকর্ড করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী এই গ্রুপের প্রধান সন্মিলিত ভাবে আবদুর রহমান সুজন (২৩) ও রাসেল (২৭)। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সুজনের পিতার নাম উল্লেখ না থাকলেও ঠিকানা দেওয়া রয়েছে ব্লক এ, রোড ১৮, বাউনিয়াবাদ, সেকশান ১১, পল্লবী।
অন্যদিকে রাসেলের পিতার নাম উল্লেখ রয়েছে হক চেয়ারম্যান। ঠিকানা দেওয়া রয়েছে মোল্লাহ ক্লাব, ব্লক এ, সেকশান ১১, বাউনিয়াবাধ, পল্লবী, ঢাকা।
সদস্যদের নাম ঠিকানার মাঝে উল্লেখ রয়েছে ১, রিয়াজ ওরফে মাওড়া রিয়াজ (১৭), পিতা -কামাল ড্রাইভার, ব্লক এ, হারুণ মোল্লাহ ক্লাব, বাউনিয়াবাধ, পল্লবী, ঢাকা। ২. রতন (১৭), পিতা আমির ওরফে চোরা আমির, ব্লক এ, হারুণ মোল্লাহ ক্লাব, বাউনিয়াবাধ, পল্লবী, ঢাকা। ৩. নাজমুল (১৮), পিতা- আনোয়ার ওরফে গাঞ্জা আনোয়ার, ব্লক এ, বাউনিয়াবাধ, পল্লবী, ঢাকা। ৪. মামুন (১৭), পিতা-দেলোয়ার, ব্লক এ, বাউনিয়াবাধ, পল্লবী, ঢাকা। ৫. বাবু ওরফে ইয়াবা বাবু (১৫), ঠিকানা- ব্লক ত, রোড ৫, সেকশান ১২, পল্লবী, ঢাকা। ৬. লিজা (১৬), ঠিকানা- ব্লক ডি, সেকশান ১২, পল্লবী, ঢাকা। ৭. টিটু (১৭), ঠিকানা- ব্লক ডি, রোড ২৯, সেকশান ১২, পল্লবী, ঢাকা। ৮. রাব্বি (১৭), ঠিকানা- ব্লক ধ, সেকশান ১২, পল্লবী, ঢাকা।
সুমন গ্রুপ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় দ্বিতীয়তেই রয়েছে পল্লবীর আলোচিত শাহিনুদ্দিন হত্যা মামলা যে গ্রুপ কর্তৃক সংগঠিত হয়, সেই সুমন গ্রুপের নাম। এই গ্রুপের প্রধান সুমনের নামে রয়েছে অসংখ্য মামলা। হত্যা, মাদক, সন্ত্রাসসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যা সুমনের দ্বারা হয়নি। সুমন গ্রুপের প্রধান হিসেবে নাম এসেছে শাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত সুমনের নাম। সুমনের পিতার নাম উল্লেখ রয়েছে আশরাফ আলী। ঠিকানা দেওয়া রয়েছে, বাসা ১০, রোড ৩১, ব্লক ডি, সেকশান ১২, পল্লবী, ঢাকা।
সদস্যদের নাম ঠিকানার মাঝে উল্লেখ রয়েছে ১, সোহেল (১৭), পিতা- ইদ্রিস, পুকুড় বাড় বস্তি, বাউনিয়াবাধ, মিরপুর ১১, পল্লবী, ঢাকা। ২. আপন আহম্মেদ (১৮), ঠিকানা- কালাপানি বস্তি, পল্লবী, ঢাকা। ৩. ওনি (১৭), পিতা- আবুল হোসেন, ঠিকানা- রোড ৩০, ব্লক ডি, সেকশান ১২, পল্লবী, ঢাকা। ৪. সাগর (১৫), ঠিকানা- সিরামিক বস্তি, পল্লবী, ঢাকা।৫. দিপু(১৬), পিতা- আল আমিন, ঠিকানা- সিরামিক বস্তি, পল্লবী, ঢাকা। ৬. কালু(১৭), ৭. রবিন (১৫), ৮. ফজল (১৭), ৯. রনি (১৭), ১০. মোঃ নাদিম (২৩), ১১. বাপ্পি(১৮), ১২. রকি(১৮), ১৩. সাব্বির (১৯), ১৪. সাগর(১৬), ১৫. মিল্টন (১৮), ১৬. পোকা ওরফে প্রকাশ(৩২), ১৭. মোঃ সেলিম(১৮), ১৮. মোঃ বাপ্পি(১৮), ১৯, বড় আল আমিন(১৭), ২০. সমিউল ইসলাম সাওন (১৮), ২১. রনি (১৭)।
বিপ্লব গ্রুপ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় তৃতীয়তে রয়েছে বিপ্লব গ্রুপের নাম। বিপ্লব গ্রুপের বিরুদ্ধে রয়েছে, জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ।
বিপ্লব গ্রুপের প্রধানের নাম এসেছে বিপ্লব মৃধা। তার পিতার নাম নান্নু মৃধা। ঠিকানা দেওয়া রয়েছে এভিনিউ ৫, বাসা ২৭, পল্লবী, ঢাকা।
বিপ্লব বাহিনীর সদস্যদের নামের তালিকায় রয়েছে, ১. মিল্টন (৩৫), ২.মাহবুব(১৭), ৩. রমজান সরদার জয়(১৮), ৪. রজ্জব(১৭), ৫. আল আমিন(১৬), ৬.খোকন (১৮)।
সাগর গ্রুপ
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে সাগর গ্রুপের সাথে সখ্য রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও বিদেশে পালাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন ও তার আপন ভাই বিদেশে পালাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিলের সাথে। এই গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে সন্ত্রাসী মামুন ও জামিল বিভিন্ন অপকর্ম করায়। এদের স্থানীয়ভাবে দেখভাল করে ৯২ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি রওশন আলী।
সাগর গ্রুপের প্রধান হিসেবে নাম রয়েছে সাগর (২২) এর। তার পিতার নাম উল্লেখ রয়েছে কাঞ্চন, ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে ব্লক সি, রোড ১১, সেকশান ১২,পল্লবী, ঢাকা।
সাগর গ্রুপের সদস্য হিসেবে নাম রয়েছে ১. পারভেজ (১৬), ২. তুরাগ (১৭), ৩. জাকারিয়া (২০), ৪. রাব্বি (১৬), ৫. মোবারক (১৭), ৬. মুন্না (১৮), ৭. ফয়সল(১৮), ৮. রাজু (১৭)।
জয় গ্রুপ
ছাত্রলীগ নেতা জয়ের নেতৃত্বে পল্লবীর অন্যতম বেপরোয়া গ্রুপ এটি। চাঁদাবাজী, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত এই বাহিনী। ছাঁদাবাজীর
মামলাও রয়েছে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় এই বাহিনীর প্রধানের নাম কামরুল ইসলাম জয় (২০), পিতার নাম নুরুল ইসলাম, ঠিকানা দেওয়া রয়েছে ব্লক ডি, পল্লবী, ঢাকা।
এই বাহিনীতে রয়েছে সাকিল (১৭), মনু (১৮), আসিকসহ অনেকে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানায় মে মাসের শেষের দিকে যোগ দেওয়া ওসি মো. পারভেজ ইসলাম সাপ্তাহিক নতুন বার্তাকে জানান, ৫টি গ্রুপের লিষ্টসহ গোয়েন্দা প্রতিবেদন পেয়েছি। গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেককে ডেকে এনে কাউন্সিলিং করে অভিভাবকের জিন্মায় দেওয়া হয়েছে। বাকী যারা রয়েছে, তাদের পর্যবেক্ষনে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন ছাড়া আমাদের নিজস্ব একটি তালিকাও রয়েছে। সেখানে যাদের নাম রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থাগ্রহণ করা হচ্ছে।
গ্যাং কালচারের জেরে চাঁদাবাজী, মাদক বাণিজ্যের বিষয়ে ওসি মো. পারভেজ ইসলাম বলেন, কিশোর গ্যাং মূলতঃ ১৮ বছরের নিচে যারা তারা হয়। কিন্তু, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যাদের নাম রয়েছে তাদের অনেকের বয়স ১৮ বছরের বেশী। তবে পল্লবীতে অদূর ভবিষ্যতে গ্যাং কালচার থাকবে না। অবশ্যই নিয়ন্ত্রনে থাকবে। পল্লবীতে বিভিন্ন ক্যাম্পে যে মাদক বাণিজ্য হয়, তাদের নিয়মিত আটক করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে, ক্যাম্পে পুলিশের পক্ষে অভিযান করা একটু কষ্ট সাধ্য। সেখানে এক সাথে দু’জন প্রবেশ করতে পারেনা। এই অবস্থায় পুলিশ যাওয়ার আগেই মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যায়। এই বিষয়ে আমাদের অফিসারদের সাথে কথা বলে ভবিষ্যতে ব্লক রেইড দেওয়ার ব্যবস্থা করব।