সাখাওয়াত কাওসার
অনলাইন জুয়ায় মজে সর্বস্বান্ত হয়েছেন রাজশাহীর প্রিমিয়ার ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুল ইসলাম ওরফে ফয়সল (৩২)। জুয়ায় লগ্নি করে একে একে ব্যাংকের প্রায় ৩ কোটি টাকা তছরুপ করেছেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ফয়সল। শুধু ব্যাংকের টাকাই নয়, ব্যবসার কথা বলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বাবা নজরুল ইসলামের সারা জীবনের সঞ্চয় পেনশনের টাকাও হাতিয়েছেন। ঢেলেছেন সেই অনলাইন জুয়ায়। তবু কোনো কিছু ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তার পরিবারের সদস্যরা। সর্বশেষ ব্যাংকের অডিটে ধরা পড়ার পরই তাদের টনক নড়ে। ততক্ষণে সব শেষ। ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে মেধাবী এই ব্যাংক কর্মকর্তার ঠাঁই হয়েছে কারাগারে। একমাত্র সন্তানের শোকে শয্যাশায়ী এখন তার বাবা-মা।
এ তো গেল মাত্র একটি ঘটনা। এমন অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মজেছেন ক্যাসিনোর আদলে বিদেশ থেকে অ্যাপসের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসা এই অনলাইন জুয়ায়। তবে দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জনপ্রিয় ফুটবল-ক্রিকেট লিগ চলাকালে অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায় জুয়ার থাবা। চলমান কোপা আমেরিকা এবং ইউরো কাপ টুর্নামেন্ট ঘিরে এরই মধ্যে মাঠে সক্রিয় জুয়ার নিয়ন্ত্রক-এজেন্ট এবং অংশগ্রহণকারীরা। তবে ভয়ংকর কর্মকান্ডের লাগাম টেনে ধরতে পারছেন না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। তবে অবাক করা তথ্য হলো, দেশের কয়েকটি প্রধান অনলাইন লেনদেন মাধ্যমকে কাজে লাগিয়েই জুয়ায় মজেছেন জুয়াড়িরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সাইবার মনিটরিং চলমান রয়েছে। অতীতের মতো ভবিষ্যতেও এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। যারাই জড়িত থাকবেন তাদেরই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কারণ এসব প্রতারকের ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন।’
৮ মে আইপিএলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অনলাইন জুয়াড়িদের সিন্ডিকেটের দুই সদস্য মো. শহীদুল ইসলাম (৩৪) এবং হোসেন গাজী (২৫)-কে আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে র্যাব-১১। র্যাব জানায়, চক্রটি অনুমোদনবিহীন বিভিন্ন ই-ট্রানজেকশনের সাইটে আইডি খুলে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেন করে। তারা অনলাইন জুয়ার সাইটে এজেন্ট আইডি নিয়ে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী তরুণ ও যুবকদের আইডি খুলে দিয়ে অনলাইনে বাজির মাধ্যমে জুয়া খেলায় প্রলুব্ধ করে। ক্রিকেটপ্রেমী তরুণরা তাদের আইডি দিয়ে ক্রিকেট বাজিতে অংশগ্রহণ করে হেরে গেলে এই এজেন্টরা ১৫ শতাংশ হারে অর্থ কমিশন লাভ করে। অনুসন্ধান বলছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনলাইন জুয়াড়িদের আটক করা হলেও বরাবরের মতো পার পেয়ে যাচ্ছে এর পরিচালনাকারীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও এর শেকড়ে কেন পৌঁছাতে পারছেন না এ বিষয় নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। যদিও ১৭৬টি সাইট বন্ধ করতে বিভিন্ন পর্যায়ের ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের নির্দেশনা দিয়েছিল বিটিআরসি। এরপরও সক্রিয় রয়েছে জুয়াড়িরা। গত কয়েক মাসে 1xbet, Bet365, Bovada, Xbet, Bet-At-Home, unibet, bettson-সহ বেশ কযেকটি সক্রিয় অ্যাপের বিষয়ে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সাইটের কান্ট্রি এজেন্ট রয়েছে ঢাকায়। জুয়া খেলায় টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা নিজেরা সহযোগিতা করে। এ ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাংকিং এজেন্সির মাধ্যমে টাকা লেনদেন করা হয়। এ রকম দুটি সাইট থেকে গত তিন মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘অনলাইন জুয়ার বিষয়ে আমরা বেশ কিছু তথ্য পাচ্ছি। এগুলো নিয়ে কাজ চলছে। একটা কথা বলতে চাই, কেউই আমাদের নজরদারির বাইরে নন। আশা করব সময় থাকতেই আপনারা নিজেদের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে সরিয়ে আনবেন।’
গত ১১ ডিসেম্বর ঢাকার সাভার থেকে অনলাইন জুয়া প্ল্যাটফরমের মো. সাব্বির আহমেদ কাওসার (১৯) ও মো. মনোয়ার হোসেন (২৬) নামের দুই অ্যাডমিনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। অভিযানে নেতৃত্ব দেন পুলিশ সুপার মাহিদুল ইসলাম। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ৭টি স্মার্টফোন, ১৪টি সিমকার্ড এবং তাদের স্মার্টফোনে অনলাইন জুয়া 1xbet Bangladesh উন্মুক্ত অবস্থায় জব্দ করা হয়। এ সাইটটি নিয়ে পরবর্তী সময়ে এদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা তদন্ত করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আমেরিকায় অবস্থানরত একজন ভারতীয় এই অ্যাপসটি পরিচালনা করে আসছেন বলে জানতে পেরেছে সিআইডি। এ ছাড়া গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছে সূত্র। ২ মে লালমনিরহাট সদর থানা এলাকা থেকে সুুজন সাহাকে গ্রেফতার করে জেলা পুলিশ। পুলিশ বলছে, তিনি ইবঃ৩৬৫ অ্যাপ অনলাইন জুয়ার অন্যতম এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। তার অন্যতম সহযোগী আরিফুল রহমান রচি। সুজন সাহাসহ ১০-১৫ জন সাব-এজেন্ট নিয়োগ করে জেলায় অনলাইন জুয়া পরিচালনা করতেন আরিফ। পুলিশ বলছে, বেটের এ জুয়ায় প্রতি ১ লাখ টাকার বিপরীতে ৫০০০ টাকা এজেন্ট ও সাব-এজেন্ট পেয়ে থাকে বলেও স্বীকার করে সুজন।
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনলাইনে জুয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময় আমরা অনেককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছি। আমাদের সাইবার টিমসমূহ এ বিষয়ে কাজ করছে। এর বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করছে পুলিশ।’
যেভাবে চলছে জুয়া : জানা গেছে, খেলা চলাকালে বাংলাদেশে অবস্থানরত জুয়াড়িরা প্রথমে বিকাশের মাধ্যমে নিজেদের নামে ডিপোজিট করে। ডিপোজিটের অর্থ দিয়ে জুয়াড়িরা জুয়া ধরে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে টাকাগুলো ডলারে রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে অনলাইনে দেশীয় বিভিন্ন ক্লাব রয়েছে। যেমন সুইট অক্টাগন, স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড, বল বিডিসহ বিভিন্ন নামে জুয়াড়িদের ক্লাব রয়েছে অনলাইনে। এ ছাড়া সেখানে যারা খেলেন তাদের অনেকেই ক্লাবের বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে খেলায় অংশ নেন। বিকাশে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে মূলত ম্যাচ নিয়ে জুয়া হয়। বিকাশে লেনদেনের মাধ্যমে জুয়া খেলার ক্ষেত্রে কোনো সাইটে মধ্যস্বত্বভোগী থাকেন। তাকে বলা হয় পেটিসখোর। পেটিসখোরের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বাজি নেওয়া। দুই বা তার অধিক পক্ষের বা গ্রুপের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জয়ী ব্যক্তিকে তা বুঝিয়ে দেন পেটিসখোর। এ ক্ষেত্রে পেটিসখোর পান টাকার ৫ থেকে ১০ শতাংশ। অনলাইনে ক্রিকেট ছাড়াও বেটিং সাইট লিংক ব্যবহার করে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ফুটবল টুর্নামেন্টসহ বিশ্বের জনপ্রিয় যে কোনো খেলাধুলা নিয়ে জুয়া হচ্ছে। পরিচিত একটি সাইটের জুয়া খেলা সম্পর্কে জুয়াড়িরা জানান, এতে নাম, ঠিকানা, বয়স ইত্যাদির সঠিক তথ্য দিয়েই অ্যাকাউন্ট করতে হয়। এমনকি অ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করার জন্য পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং ব্যাংক স্টেটমেন্টের ছবি তুলে সাবমিট করতে হয়। ২০ টাকা জমা করেই এতে বেট করা যায়। অ্যাকাউন্ট খুলতে প্রয়োজন হয় ৫০০ টাকা। সাধারণত জুয়ার টাকা পেমেন্ট করা হয় নিটেলার ও স্ক্রল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। এ ছাড়া ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন অনেকে। টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে নিটেলার ও স্ক্রল অ্যাকাউন্টের ব্যবহারই বেশি বলে জানান জুয়াড়িরা। অ্যাকাউন্ট লগইন করে কেউ তার পছন্দমতো খেলাটি বেছে নেন। তারপর কোন দলের পক্ষে, কিসের ওপর বেট করবেন তা সিলেক্ট করতে হয়। সেই সঙ্গে ডলার বা সেন্টের পরিমাণও সিলেক্ট করে ক্লিক করতে হয়। অতঃপর হারলে টাকা কেটে নেবে আর জিতলে অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হবে। শখে এবং পরিশ্রম ছাড়া বসে বসে অর্থ আয় করতে গিয়ে এতে নেশাগ্রস্ত হচ্ছেন তরুণরা। লাভ হলে বাজি ধরা ডলারের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি, আর হারলে যা ধরলেন তা- এই লোভে এ খেলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন অনেকে। জুয়া খেলায় সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। তাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী, খুদে ব্যবসায়ী।