কইয়ের তেলে ইলিশ ভাজছে ইভ্যালি সরকারি কোনো নির্দেশনাই মানছেনা

কইয়ের তেলে ইলিশ ভাজছে ইভ্যালি সরকারি কোনো নির্দেশনাই মানছেনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান (ই-কমার্স) ইভ্যালির বিধিবহির্ভূত ব্যবসা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। তাদের অবৈধ ও ধাপ্পাবাজি কর্মকা- বন্ধে কাজে আসছে সরকারের কোনো নির্দেশনাও। এতে হরদম প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রাহক। একদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে অপরদিকে সব নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিনকে দিন লাগামাহীন হয়ে উঠছে প্রতিষ্ঠানটি। আফতাব নগরের বাসিন্দা, চাকরিজীবী সাবিনা আক্তার নামের এক সচেতন গ্রাহক বলছেন, ‘একবার ভাবুন তো ৪০ হাজার টাকার ফ্রিজ ১৫ হাজার টাকায় কীভাবে দেওয়া সম্ভব? এই অফার দেখে পাবলিকের মাথা তো পুরাই নষ্ট। অর্ডার পড়ল দুই হাজার জনের। তার মানে ইভ্যালির কাছে জমা হলো ৩ কোটি টাকা (২০০০ গুণ ১৫০০০)। কিন্তু তিন মাসেও ওই দুই হাজার লোককে পণ্য দেওয়া হয় না। এই তিন মাসে ওই ৩ কোটি টাকা অন্য কোনো খাতে খাটিয়ে আয় করে চলেছে ইভ্যালি।’
সাবিনা বলেন, ‘কইয়ের তেলে কই ভাজার যে বাংলা প্রবাদ আছে তা ইভ্যালির ব্যবসা দেখেই বোঝা যাবে। বরং ইভ্যালি কইয়ের তেলে শুধু কই ভাজছে না, তারা কইয়ের তেলে রীতিমতো ইলিশ মাছ ভেজে খাচ্ছে।’ সূত্র জানায়, দেশে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ই-কমার্স সাইট হয়েছে, যেগুলো গ্রাহকদের অবিশ্বাস্য ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করছে। তবে টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহে বারবার সময় নেওয়ার অভিযোগ আছে। তাদের ব্যবসার কৌশলও স্পষ্ট নয়। এ কারণে নানা সন্দেহ-সংশয় জন্ম নিয়েছে মানুষের মধ্যে। এর মধ্যেই ই-কমার্স সাইট ইভ্যালিকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তদন্ত চালিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি এক টাকা আয় করতে সাড়ে তিন টাকার বেশি ব্যয় করে। তাদের সম্পদের তুলনায় দেনা ছয় গুণ। ফলে তারা এই টাকা আদৌ পরিশোধ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোরের পাতার পক্ষ থেকে কথা বলা হয় এই ই-কমার্স সাইটের তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইভ্যালির মানুষের সাথে প্রতারণার গোপন কৌশল জানিয়েছেন তারা।
তারা বলেন, ‘ইভ্যালির নিজস্ব মূলধন ছিল খুবই কম। নেই নিজস্ব কোনো পণ্য। তারপরও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্যের ওপর অবিশ্বাস্য সব ছাড় দিয়ে আসছে, যে দামে মূল কোম্পানিও পণ্য বিক্রির চিন্তা করতে পারে না। এছাড়া তারকাদের দিয়ে ব্র্যান্ডিং করছে; দামি দামি পণ্য উপহার দিয়ে প্রশংসাসূচক পোস্ট দেওয়াচ্ছে। বিষয়টা এমন যেন তারকারা পণ্যটি ইভ্যালি থেকে কিনেছেন এবং কোনো রকম ঝুটঝামেলা ছাড়াই পেয়েছেন’। মূলত এভাবে ইভ্যালিকে সাধারণ মানুষের কাছে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। ক্রেতা ধরতে নিজেদের কর্মী দিয়ে ফেইক আইডি খুলে পণ্যের রিভিউ করাচ্ছে। রিভিউ দেওয়ায় ‘পেইড’ লোক দিয়েও, যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। আবার গণমাধ্যমকর্মীরা যাতে কোনো সমালোচনা না করেন সেদিকেও আছে তাদের বিশেষ নজর। এভাবেই গত আড়াই বছর ধরে ব্যবসা করছে ইভ্যালি। কিন্তু গ্রাহক বা পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান- কোনো পক্ষের সঙ্গেই কথা রাখছে না, তাদের টাকা আটকে রাখছে মাসের পর মাস। তাদের কাছে দেনা রেখে সেই টাকা দিয়েই চালু করছে নতুন নতুন ব্যবসা। কিনছে কোম্পানিও। এ পুরো বিষয়টাকে ‘কই মাছের তেল দিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেক গ্রাহক, এমনকি ইভ্যালির অনেক কর্মকর্তাও।
রাজেকুজ্জামান নামের আরেকজন, যিনি একসময় অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন, তিনি ভোরের পাতাকে বলছেন, ‘ইভ্যালি দুই টাকার জিনিস দেড় টাকায় বিক্রি করছে। এটা কীভাবে সম্ভব? ভর্তুকির টাকাটাই বা আসছে কোথা থেকে?  তিনি সাবিনা আক্তারের দেওয়া সূত্র ধরে বলেন, ৪০ হাজার টাকার ফ্রিজ ১৫ হাজার টাকায় কেনার জন্য যদি দুইহাজার অর্ডার পড়ে, তাতে ইভ্যালির কাছে জমা হচ্ছে ৩ কোটি টাকা। অথচ তিন মাসেও অই পরিমাণ লোককে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হয় না।’  তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘ইভ্যালি এভাবে যে ৩ কোটি টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে তোলে, তা ব্যাংকে রেখে ৫% হারেও যদি সুদ নেয়, তাতেও মাসে আয় হয় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ৩ মাসে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এদিকে প্রতিষ্ঠানের ওপর যাতে চাপ না পড়ে সে জন্য ২০০০ জনের মধ্যে ১০০ জনের জন্য ফ্রিজ কেনা হয় ৩৫ হাজার টাকা দরে। তাহলে খরচ হলো ৩৫ লাখ টাকা, হাতে থাকল ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এখন যে ১০০ ফ্রিজ ডেলিভারি দেওয়া হলো, যারা পেলেন তারা তো খুশিতে আত্মহারা। উৎফুল্ল হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দেন, আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি। আর যারা পেলেন না তারা ভাবতে থাকলেন আরও কিছুদিন অপেক্ষা করি। যেহেতু অনেকেই পেয়েছেন, তাই আমিও পাব। কিন্তু সেই পাওয়াটা ইভ্যালির ওয়েবসাইটে ঝুলেই থাকে। এ রকম অভিযোগের ছাঁপিও বাড়তে থাকে।’
এই ই-কমার্স সাইট ৪৫ কর্মদিবসে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও সে প্রতিশ্রুতি রাখে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এটা কেন হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে ইভ্যালির এক কর্মকর্তা বলেন বলেন, ‘আমি একটা ইনভয়েস নম্বর (পণ্য কেনার আইডি নম্বর) অ্যাডমিন প্যানেল দিলে বুঝতে পারি কার প্রোডাক্টটা কোন প্রসিডিউরে আছে। কাস্টমাররা ক্লেইম করেছেন কি না, প্রোডাক্ট পেয়েছেন কি না, আপডেটটা কী? বা ৪৫ কার্যদিবস হয়ে গেছে, প্রোডাক্টটা কেন ডেলিভারি হয়নি ইত্যাদি বিষয় দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে দেখানো হয়, যেগুলো ৪৫ দিন পার হয়ে গেছে সে ক্ষেত্রে পিকড দেখায়। এটা হলো পিও (প্রোডাক্ট অর্ডার) সেন্ট টটু সেলার। তার মানে তারা বোঝায় অর্ডারটা সেলারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে ইভ্যালি। কিন্তু আসলে দেয়নি।’
রাজেকুজ্জামানের ভাষ্যমতে, ইভ্যালি বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি করে ‘দালালের মতো’। উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ধরেন কিয়াম নামে একটা কোম্পানি আছে। ওরা ট্রিমার, ফ্রাইপ্যান ইত্যাদি বিক্রি করে। ওদের একটা প্রোডাক্ট আপনি অর্ডার করেছেন। সে প্রোডাক্টটা ৪৫ দিন পার হওয়ার পর ইভ্যালির প্যানেলে দেখাচ্ছে পিকড। অথচ ইভ্যালি থেকে পারচেজ অর্ডার পাঠানো হয়নি। এখন কাস্টমার তো ভাবছে আমার প্রোডাক্টট তো সেলারের হাতে, সেলার আমাকে দিচ্ছে না কেন? ইভ্যালির কাজ তো ইভ্যালি করে দিয়েছে। কাস্টমার ইভ্যালির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তখন ইভ্যালি বলে আপনার পারচেজ অর্ডার সেলারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেলার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রোডাক্ট দিয়ে দেবে। অথচ দুই মাস ছয় মাস পার হয়ে যায়, সেলার ওই কাস্টমারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করে না।’ তাহলে আসল ঘটনা কী জানতে চাইলে রাজেকুজ্জামান বলেন, ‘একটা উদাহরণ দেই। আমি জেনেছি, কিয়াম ৭০ লাখ টাকা পাবে ইভ্যালির কাছে। এখন একটা কোম্পানি যখন আপনার কাছে ৭০ লাখ টাকা পায়, তখন আপনি নতুন ২০ লাখ টাকার পণ্য অর্ডার করলে তারা কি আর পণ্য দেবে?’
তিনি বলেন, ‘এদিকে কাস্টমার নানা ধরনের রিভিউ দেখে ভাবে, একই প্রক্রিয়ায় অর্ডার করে অনেকে তো প্রোডাক্ট পেয়েছে, আমি পাচ্ছি না কেন? আবার ইভ্যালি বলে, তারা পারচেজ অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। তাহলে দোষটা নিশ্চয়ই সেলারের। এভাবে বড় একটা শুভংকরের ফাঁকি চলে। এভাবে ডেট ওভার হয়, আবার ইভ্যালি দেখায় অনটাইমে অর্থাৎ ৪৫ দিনেই পিকড। অথচ কাস্টমার প্রোডাক্ট পায় না।’
ইভ্যালির ওই কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ইভ্যালির কিছু প্রসেস আছে। যেমন প্রথমে প্রসেসিং, তারপর শিফটিং, সবশেষ পিকড। এই পিকড মানে হলো, ইভ্যালির দায়িত্ব বা কাজ শেষ। ৪৫ দিন হয়ে গেলে ইভ্যালি অর্ডারটা সেলারের কাছে পাঠিয়ে দেবে, সেলার কুরিয়ারের কাছে দিয়ে দেবে। কিন্তু ইভ্যালি এখানে টাকা বকেয়া রাখছে। এর ফলে সেলাররা প্রোডাক্ট পৌঁছায় না গ্রাহকের কাছে।’ এভাবেই ধাপ্পাবাজি করে চলেছে ইভ্যালি। বেশিরভাগ সময় কাস্টমারকে বলছেন, তাদের দোষ নেই তারা পারচেজ অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। সেলার প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিচ্ছে না। অপেক্ষা করেন ডেলিভারি দিয়ে দেবে। এভাবে দিনের পর দিন পার করতেই থাকে। এ ধাপ্পাবাজির কারণ হিসেবে ই-কমার্স বিশেষজ্ঞ অনেকেই বলছেন, ‘এ ধাপ্পার প্রধান কারণ ‘অবৈধ উপায়ে টাকা কামানোর লোভ’।
কাস্টমার অর্ডার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা পায় ইভ্যালি। ওটা নিয়ে তারা কাজে লাগায়। কাস্টমারকে যা তা বোঝানো যায়। ইভ্যালি ক্লায়েন্টকে বোঝায়, আমরা তো সবকিছু করে দিছি। সেলার কেন প্রোডাক্ট দিচ্ছে না, ওদের মনে হয় সাপ্লাই নাই। এভাবে নানান কিছু বোঝায়। কারণ কাস্টমার তো তখন তাদের ফাঁদে আটকা। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা ছাড়া তার উপায় থাকে না।
অপরাধ তথ্য প্রুযুক্তি