দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর আইস

দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর আইস

নিজস্ব প্রতিবেদক

মিথাইল অ্যামফিটামিনযুক্ত ক্রিস্টাল, দেখতে কাচ কিংবা বরফের টুকরার মতো। তাই একে আইস বলে ডাকা হয়। বিভিন্ন দেশে এটি ‘সেবু’ ও ‘ডি ম্যাথ’ নামেও পরিচিত। দুই বছর আগে বাংলাদেশে প্রথম ধরা পড়া মাদকটি এখন নতুন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইয়াবার উপাদানে তৈরি শত গুণ বেশি ক্ষতিকর মাদকটির কারবার শুরু হয়েছে ইয়াবার মতোই। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া থেকে এই মাদকের কিছু চালান ভিন্ন পথে এলেও মূলত মিয়ানমার থেকে ইয়াবার রুটেই আসছে। এরই মধ্যে টেকনাফে দুই কেজি ওজনের দুটি বড় চালানসহ চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অন্তত ১৫টি আইসের চালান ধরা পড়েছে। কারবারিদের কাছ থেকে ইয়াবার সঙ্গে আইসও উদ্ধার হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকায় ধরা পড়া নতুন ধরনের মাদক এলএসডিচক্রের কাছেও মিলেছে আইস। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ইয়াবা কারবারি, নতুন মাদক কারবারি ও উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণ মাদকসেবীদের মধ্যে আইসের প্রচলন বাড়ছে। সাধারণ মানুষের কাছে অচেনা এবং পরিবহন সহজ হওয়ায় মাদক কারবারিরা মিয়ানমার থেকে ইয়াবার পরিবর্তে আইস আনছেন। ইয়াবার মতোই এমএলএম পদ্ধতিতে বেচাকেনা চলে এই মাদকের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে এলএসডি, ডিএমটি, ম্যাজিক মাশরুমসহ নতুন ধরনের মাদক সহজলভ্য নয়। অনলাইনে অর্ডার করে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে পার্সেলে আনতে হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও আইস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। এ কারণে সীমান্তসহ মাদক কারবারিচক্রের ওপর কঠোর নজরদারি শুরু করেছে প্রশাসন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সদ্যোবিদায়ি মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্রিস্টাল ম্যাথ বা আইস ইয়াবার মতো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এটি মিয়ানমার থেকে পাচার হচ্ছে। ট্রানজিট পাচারের তথ্যও পাওয়া গেছে। এমন তথ্যের পর ডিএনসি বিশেষভাবে নজরদারি বাড়িয়েছে।’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘চালান ধরার পর আমরা তথ্য পেয়েছি, থাইল্যান্ড মিয়ানমার হয়ে আইসের চালান ২০১০ সাল থেকে অল্প পরিমাণে এসেছে। সম্প্রতি কারবারিরা এটি বেশি পাচার করছে। অন্য নতুন মাদকগুলো পার্সেলে এলেও আইস টেকনাফ থেকে এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে নজরদারি বাড়িয়ে আমরা কয়েকটি চালান আটক করেছি। এগুলো ছোট আকারে পরিবহন করা হয়। তবে আমরাও গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করেছি।’

ডিএনসির প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেশ কিছু আইসের নমুনা এরই মধ্যে আমরা পেয়েছি। এক কথায় বলা যায়, এটি সরাসরি ইয়াবার কাঁচামাল। ইয়াবার চেয়ে শতগুণ বেশি ক্ষতিকর। ইয়াবার অ্যামফিটামিনের সঙ্গে ক্যাফেইন থাকে। আর ক্রিস্টাল মেথ হচ্ছে সরাসরি অ্যামফিটামিন। এখনো এটি উচ্চবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সহজলভ্য হলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্রিস্টাল মেথ তৈরি হয় থাইল্যান্ডে। পাশাপাশি মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারেও তৈরি হচ্ছে। এই তিনটি দেশ থেকে এটি ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়। বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন কারবারিরা। সেই সুযোগে এখানে বাজার তৈরির চেষ্টা চলছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি ও উত্তরাকেন্দ্রিক আইস বিক্রির চক্র গড়ে উঠেছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, থাইল্যান্ড-মিয়ানমার হয়ে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের নোয়াখালীপাড়ার সমুদ্র দিয়ে, হ্নীলার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবং নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ি-সমতল এলাকা দিয়ে আইসের চালান আসছে। টেকনাফ সীমান্তে বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে রুট পাল্টে কারবারিরা শাহপরীর দ্বীপ ঘোলারচর, দক্ষিণপাড়া সৈকত পয়েন্ট, মাঝের পাড়া, সাবরাং হারিয়াখালী, কচুবনিয়া, মুন্ডারডেইল, খুরের মুখ, সদর ইউনিয়নের মহেশখালিয়া পাড়া, বাহারছড়ার নোয়াখালী, শীলখালী, শামলাপুর, উখিয়ার ইমামের ডেইল, ইনানী, হিমছড়ি সৈকত পয়েন্ট দিয়ে চালান খালাস করছেন।

গত ২৫ মার্চ টেকনাফের উত্তর বরইতলী থেকে মো. হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে দুই কেজি আইসসহ গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। হোসেন বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালী পাড়ার কালা মিয়ার ছেলে। তবে তাঁর কারবারের মূল হোতা একই এলাকার মৃত নবী হোসেনের ছেলে রশিদ র‌্যাবের হাত ফসকে পালান। গত ৮ মে হ্নীলার নয়াপাড়ায় প্রায় এক কেজি আইসসহ হামিদ নামে এক রোহিঙ্গা তরুণকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। লেদার ২৪ নম্বর নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকতেন হামিদ। ১৩ এপ্রিল টেকনাফ শীলখালী চেকপোস্টে তল্লাশি করে বিজিবি সদস্যরা ১৬৭ গ্রাম আইসসহ একজনকে গ্রেপ্তার করেন।

সূত্র জানায়, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের খুলশীর মোজাফফর নগর বাইলেইনে ১৪০ গ্রাম আইসসহ শফিউল আলম ও ইয়াছিন রানা নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ২ মে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কলেজ গেট থেকে আতাউল করিম নামে এক ব্যক্তিকে ২০০ গ্রাম আইসসহ গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। ৮ মে টেকনাফে উত্তর লম্বরী থেকে ১০০ গ্রাম আইস ও ১৪ হাজার ইয়াবাসহ ওসমান গণি নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ১৬ জুন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জারটেক থেকে পাঁচ গ্রাম আইসসহ সাগর নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এ ছাড়া টেকনাফে ১০০ গ্রাম আইসসহ আরেক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। টেকনাফ থানার ওসি হাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইয়াবার মতোই পাচার হয়ে আইস আসছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। অভিযান চালিয়ে আমরা দুটি চালান ধরেছি। নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।’

২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশে প্রথম রাজধানীর জিগাতলার বাড়িতে হাসিব মুয়াম্মার রশিদ নামে এক যুবকের ল্যাবে পাঁচ গ্রাম আইস পায় ডিএনসি। ২০১৯ সালেরই ২৭ জুন ভাটারা থেকে আজাহ আনাইওচুকোয়া ওনিয়েনসি নামে এক নাইজেরিয়ানকে ৫২২ গ্রাম আইসসহ গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। গত বছরের ৪ নভেম্বর ডিবি পুলিশ ৬০০ গ্রাম আইসসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। গত ১৪ জানুয়ারি হাতিরপুল ও হাতিরঝিল থেকে ডিবি পুলিশ আইসসহ আরো চার মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করে।

গত ৩০ মে পুলিশ এলএসডিচক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের একজন নাজমুলের কাছে চারটি এলএসডি ব্লটের সঙ্গে এক গ্রাম আইসও পাওয়া যায়।

জানতে চাইলে খিলগাঁও থানার ওসি ফারুকুল আলম বলেন, ‘এরা এলএসডির সঙ্গে আইস খায় ও ব্যবসা করে। এদের কেনাবেচার লোকাল সার্কেল আছে।’

১৭ জুন উত্তরার আজমপুর থেকে ১২০.৮ গ্রাম আইসসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তৌফিক হোসাইন ও আরাফাত আবেদীন ওরফে রুদ্র নামে দুজন ভাড়া বাসায় মেথ ল্যাব তৈরি করে।

র‌্যাব-৩-এর এএসপি অভিজিৎ দাস জানান, তিন-চার বছর ধরে কক্সবাজার থেকে আইস এনে সেবনের পাশাপাশি বিক্রি করছিলেন তাঁরা। চাহিদা বাড়ায় চক্রটি ভেজাল তৈরি শুরু করে। আইস কেনে এমন ৪৫ জনের নাম পাওয়া গেছে, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী।’

অপরাধ