২০২৩ সালের নির্বাচন হোক সবার

২০২৩ সালের নির্বাচন হোক সবার

 

  • মো: সরোয়ার উদ্দিন

 

পলাশীর প্রান্তরে বেনিয়া ইংরেজদের কাছে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে আমরা কার্যত হারিয়েছিলাম আমাদের স্বাধীনতা। আমরা বন্দী হলাম পরাধীনতার নাগপাশে। প্রায় ২০০ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের সুদীর্ঘ রক্তনদী পাড়ি দিয়ে আমরা পেলাম নতুন দেশ পাকিস্তান। ভাবলাম, আমরা এখন স্বাধীন, এখন আমাদের পথ চলা হবে স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের মহাসড়ক ধরে। কিন্তু আমাদের সেই মোহ ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। প্রত্যক্ষ করলাম, কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকেই কেড়ে নেয়নি, সেই সাথে আমাদের স্বাধীনতাকেই করে তোলে বিপন্ন। তাই আবার আমাদের নামতে হলো স্বাধীনতা লাভের লড়াইয়ে। আবারো অনেক রক্তের নদী পাড়ি দিয়ে আমরা বিজয় পেলাম। পেলাম স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ যেখানে প্রত্যাশা ছিল, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা স্থায়ী রূপ নেবে।

এরই মধ্যে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি স্বাধীনতার পর প্রায় ৫০ বছর। এরপরও আমরা এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় চরম ব্যর্থ। আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা, চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা- যেন এক সোনার হরিণ। সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা ভাবাও এখন যেন পাপ। অথচ সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য উপাদান। নির্বাচন নিয়ে দেশে বিতর্কের শেষ নেই। তবে সমাধানের পথে কেউ হাঁটছি না। অথচ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা আমরা সবাই বলছি বড় গলায়। ব্যাপারটি যেন এমন- সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য নয়।

আমরা জানি, এ পর্যন্ত আমাদের দেশে পাঁচটি পদ্ধতিতে মোট এগারোটি জাতীয় তথা সংসদ নির্বাচন হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে একটি : ১৯৭৩ সালে; প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারের অধীনে তিনটি : ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮; বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি : ১৯৯১ সালে। বিএনপি সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন একটি; সাংবিধানিকভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি : ১৯৯৬-এ, ২০০১ সালে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে। আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে দুইটি : ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন।

এই এগারোটি নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। প্রতিটি দলীয় সরকারের অধীনে; সংসদীয় কিংবা প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরাই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। এসব নির্বাচনে কমবেশি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তবে সীমাহীন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে। এর বিপরীতে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন তিনটি মোটামুটি নিরপেক্ষ এবং সবমহলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে- এমন একটি প্রবল জনধারণা রয়েছে। এর পেছনে কারণও আছে। জনগণ দেখেছে, এই তিনটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পতন ঘটেছে, বিরোধী দল বিজয়ী হয়েছে।

স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরের মধ্যে জাতিকে উপহার দেয়া হয় আমাদের সংবিধান। এই সংবিধানে ৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে : ‘দেশের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ অথচ কার্যত জনগণ আজ সে অধিকারহারা। জনগণের ভোটের অধিকার নেই। চাওয়া-পাওয়ার প্রতিনিধি নির্বাচিত করার অধিকার নেই। বর্তমানে দেশে গণতন্ত্র, দেশের মালিক জনগণের অধিকার একেবারেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জনগণের মৌলিক ও রাজনৈতিক অধিকার পুনরুদ্ধার অপরিহার্য। এ অধিকার অর্জনে জনগণই একমাত্র ভরসা।
সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা এ দেশের মানুষের মন থেকে কখনোই উবে যায়নি। সব কিছু ঠিক মতো চললে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০২৩ সালে। এখন আমাদের ভাবতে হবে, অতীতের সব ভুলভ্রান্তি ধুয়েমুছে পেছনে ফেলে জাতিকে একটি বিতর্কহীন সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া কি করে সম্ভব করে তোলা যায়। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই তা সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে : তা কী করে সম্ভব?

জনগণ দেশের মালিক। এ সত্যের বাস্তবায়ন ঘটে নির্বাচনে জনগণের অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে। তাই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না- এই অজুহাতে নির্বাচন বর্জন কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং লক্ষ্য হতে হবে নির্বাচনে সবার আগে অংশ নেয়া নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অর্থবহ করে তোলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা।

অতএব, ২০২৩ সালের অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে পৌঁছা নিশ্চিত করতে হবে। ভোট দেয়ার পরও ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রের আশপাশে থাকতে হবে সম্মিলিতভাবে। অনিয়মের কারণে ভোট বঞ্চিতরা তাদের ভোট কেন্দ্র ও ভোটার নম্বর উল্লেখসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি আলাদা আলাদাভাবে অনলাইনে পাঠাতে হবে : জেলা প্রশাসক (রিটার্নিং অফিসার), প্রধান বিচারপতি, বিভিন্ন গণমাধ্যম, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের কার্যালয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতেও। আরেকটি কথা বলে রাখি, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হয়, সে বিষয়টি বাস্তবে প্রমাণিত ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন থেকে। অতএব, বর্তমান সরকার যাবতীয় অজুহাত পায়ে ঠেলে যত তাড়াতাড়ি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সাংবিধানিকভাবে যাবে, ততই সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত হবে এবং দলীয় জমিদারি ব্যবস্থার অবসান ঘটবে। আবারো বলছি, জনগণ দেশের মালিক। জনগণকেই তাদের মালিকানা সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ দাবি নিয়েই তাদের নির্বাচনী মাঠে থেকে তাদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই বলছি : স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের তরে যে জন করবে জীবনদান, সে জনই পাবে একদিন জাতীয় বীরের সম্মান।

মতামত