নিজস্ব প্রতিবেদক
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, সিদ্দিকুর রহমান, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে ঈদের পর কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে কারখানা খোলা রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি আমরা। সচিব আমাদের আশ্বস্ত করছেন, তিনি আমাদের চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেবেন। এ ছাড়া শনিবার সরকারের একটি বৈঠক রয়েছে, সেখানে ঈদের পর কঠোর লকডাউনে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা চালু থাকবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করলেও রপ্তানিমুখী পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা উৎপাদন চালু রাখার সুযোগ পায়। সর্বশেষ গত ২৮ জুন শুরু হওয়া সীমিত ও পরে ১ জুলাই শুরু হওয়া কঠোর বিধিনিষেধে পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা চালু আছে। তবে গত মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা নতুন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঈদ-পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল পর্যন্ত সব ধরনের বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে। তারপর আবার কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হবে। চলবে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত। তবে পার্থক্য হচ্ছে, এবার কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সব ধরনের শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা। বিষয়টি নিয়ে গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশানে বিজিএমইএর কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, সরকারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে যা আছে
ঈদের পর দুই সপ্তাহের লকডাউনে পোশাক ও বস্ত্র কারখানা চালু রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীকে যৌথভাবে চিঠি দিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান, বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী, বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) চেয়ারম্যান এম শাহদাৎ হোসেন ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আবদুল কাদের খান।
ব্যবসায়ী নেতারা চিঠিতে লিখেছেন, দেশের মোট পণ্য রপ্তানি আয়ে বস্ত্র খাত অর্থাৎ তৈরি পোশাক, টেরিটাওয়েল ও হোম টেক্সটাইলের অবদান ৮৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১৪ দিনে এ খাতের রপ্তানি আয় ১৬৭ কোটি মার্কিন ডলার। তার মানে প্রতিদিন গড়ে ১১ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের জুনের চেয়ে চলতি বছরের জুনে খাতটির রপ্তানি আয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ২৫ শতাংশ।
পাঁচ ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি লিখেছেন, করোনায় গত ১৫ মাসে বিদেশি ক্রেতারা অনৈতিকভাবে পণ্যের উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্য দিয়েছেন। তারপরও বাজার ধরে রাখা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা চালিয়ে রাখার স্বার্থে লোকসান দিয়েও কারখানা চালানো হয়েছে। এ সময়ে অনেকেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ সব দেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ফলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের হাতে পর্যাপ্ত কার্যাদেশ আছে। জাহাজীকরণে প্রচণ্ড চাপ থাকায় ক্রেতারা বলেছেন, বিলম্ব হলেই যেন উড়োজাহাজে পণ্য পাঠানো হয়। এমন সময়ে ঈদের ছুটিসহ ১৮-২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে গ্রীষ্ম, বড়দিন ও শীতের ক্রয়াদেশ হাতছাড়া হয়ে যাবে। এক মাসের রপ্তানি সূচি গড়বড় হলে পরবর্তী ছয় মাসের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ঘোষিত ১৪ দিন, ঈদের ছুটি ৩ দিন ও ফিরে আসতে ২ থেকে ৩ দিন, অর্থাৎ মোট ১৯-২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের কর্মস্থলে ধরে রাখা যাবে না। তাঁরা ছুটে যাবেন উত্তরাঞ্চল-দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেগুলো এখন করোনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এরপর তাঁরা ফিরে এলে কোভিড সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে ব্যবসায়ীরা আরও লিখেছেন, পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে কাজ করেন। দিনের অধিকাংশ সময় (মধ্যাহ্ন বিরতিসহ ১১ ঘণ্টা) কর্মক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে থাকেন তাঁরা। গত রোজার ঈদে কাজের চাপ কম থাকায় ছুটিও কিছুটা শিথিল ছিল। কিন্তু এখন কাজের প্রচুর চাপ থাকায় ঈদে লম্বা ছুটির সুযোগ নেই। কিন্তু ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ঘোষিত ১৪ দিন, ঈদের ছুটি ৩ দিন ও ফিরে আসতে ২ থেকে ৩ দিন, অর্থাৎ মোট ১৯-২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকদের কর্মস্থলে ধরে রাখা যাবে না। তাঁরা ছুটে যাবেন উত্তরাঞ্চল-দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেগুলো এখন করোনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ওই সব অঞ্চল থেকে কর্মস্থলে ফিরে এলে কোভিড সংক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ ছাড়া ২০ দিন বন্ধের পর কারখানা খুললে জুলাই মাসের বেতন পরিশোধ করার প্রসঙ্গ আসবে। তখন বেতন পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে ঈদের পর দ্রুত কারখানা খুলে দেওয়া হলে রপ্তানিমুখী শিল্প বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাবে।