নিজস্ব প্রতিবেদক: ঈদ ঘিরে ৯ দিনের জন্য তুলে নেয়া হয়েছে লকডাউন; বিধিনিষেধ না থাকায় প্রথম দিনেই ফিরে এসেছে রাজধানীর পুরোনো চেহারা।
কভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গণপরিবহন চলছে, দূরপাল্লার বাস, ট্রেন, লঞ্চ চলাচল শুরু হওয়ায় আগেভাগে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন মানুষ।
রাজধানীর সড়কগুলোয় দেখা গেছে ব্যাপক ভিড়, আগের মতো যানজট। তবে প্রথম দিন নগর পরিবহনের বাস কম থাকায় মোড়ে মোড়ে অনেক মানুষকে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল আর লঞ্চ ঘাটে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কড়াকড়ি থাকলেও রাস্তাঘাটে অনেকের মুখে মাস্ক নেই। অনেকে আবার মাস্ক ঝুলিয়ে রেখেছেন থুতনিতে।
বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় দোকানপাট, মার্কেটÑসবই খুলে গেছে আবার। দুই সপ্তাহ পর লকডাউন ওঠায় মার্কেটগুলোয়ও ছিল বেশ ভিড়।
গাবতলী বাস টার্মিনালে দূরপাল্লার গাড়ি ছাড়তে শুরু করেছে সকাল থেকে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে অর্ধেক সিট খালি রাখা হচ্ছে। মাস্ক না থাকলে যাত্রীদের উঠতে দেয়া হচ্ছে না।
সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, সকাল থেকে প্রচুর গাড়ি ছাড়া হয়েছে। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানার ও মানানোর চেষ্টা করছেন। তবে গাড়ি ব্যবস্থাপনায় অসচেতনতার কারণে সড়কে যানজট হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাস, ট্রাক, গরুর গাড়ির কারণে রাস্তায় বেশ যানজট। নারায়ণগঞ্জ, দাউদকান্দি-চান্দিনায় বেশ চাপ পড়ছে। ট্যাংক লরির জন্য ভিন্ন রুট ব্যবহার করতে পারলে ভালো হবে। যানজটের কারণে গাড়ির সংকটও হচ্ছে কিছু।
তেজগাঁও বিভাগের ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার সাহেদ আল মাসুদ বলেন, বাসসহ অন্যান্য গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে। বাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কিনা, তা নজরদারি করা হচ্ছে।’
ট্রেনেও অর্ধেক আসানে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। সকালে কমলাপুর স্টেশনে দেখা গেছে বেশ ভিড়। মাস্ক ও টিকিট ছাড়া প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
রেল স্টেশনের প্রবেশ পথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা হয়েছে। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে পরিস্থিতি দেখে গেছেন।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রেলওয়ে জানিয়েছে, লকডাউন শিথিল হওয়ায় ৩৮টি আন্তঃনগর এবং ১৯টি মেইল ও কমিউটার ট্রেন দিয়ে বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে ট্রেন যাত্রা।
দেশের তিনটি এয়ারলাইনস অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চালাতে শুরু করেছে সকাল থেকে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার জানান, বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ও যশোর রুটে তিনটি ফ্লাইট ছেড়ে গেছে তাদের।
যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলও শুরু হয়েছে। ভোর ৬টার দিকে এমভি ইমাম- হাসান ঢাকা সদরঘাট থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়, আর সকাল ৭টায় ছেড়ে যায় সোনারতরী লঞ্চ।
বিআইডব্লিউটিএ’র পরিবহন পরিদর্শক দিনেশ কুমার সাহা বলেন, যাত্রী মোটামুটি রয়েছে। এতদিন পর লঞ্চ চলাচল শুরু হলেও উপচে পড়া ভিড় নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই লঞ্চগুলো ছাড়া হচ্ছে।
এমভি টিপু লঞ্চের মহাব্যবস্থাপক ফারুক হোসেন জানান, সরকারি নির্দেশনা মেনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ছাড়ছেন তারা।
দুই সপ্তাহের লকডাউনের শেষ দিকেই যানবাহন চলাচল বেড়ে গিয়েছিল রাজধানীতে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে অটেরিকশা, মোটরবাইকসহ সব ধরনের বাহনই চলছে। তার ওপর শপিংমল-বিপণিবিতানসহ দোকান-পাট খোলায় বহুগুণে বেড়েছে মানুষের পদচারণা।
গুলশান থেকে আসা গাড়িচালক আলিমুদ্দিন বলেন, সকাল সাড়ে ৯টায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে কাকরাইল আসতে তার লেগেছে এক ঘণ্টা। এখন কাকরাইল মোড়ে জ্যামে বসে আছি। লকডাউন শেষ হতে না হতে রাস্তার এই অবস্থা।
লকডাউনে যান্ত্রিক গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও সব রাস্তায় রিকশা চলাচলের অনুমতি ছিল। এখন যানজট বেড়ে যাওয়ায় রিকশাচালকরা হতাশ। প্রধান সড়কগুলোয় যানজটে তাদের সময় নষ্ট হয়।
একজন রিকশাচালক বলেন, এতদিন যাত্রী কম থাকলেও চালায় আরাম ছিল। এখন মালিবাগ থেইক্কা একটা খ্যাপ নিয়া মতিঝিলে গেলে দেড় ঘণ্টা লাগে। ভাড়া দেয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা। তার চেয়ে ওই সময়ে গলি মধ্যে ৩০ টাকায় খ্যাপ মারলে লাভ বেশি।
ট্রাফিক জ্যামের অবস্থা দেখে শান্তিনগরে বাজার করতে আসা জাফর উল্লাহ চৌধুরী বলেন, লকডাউন শেষে গাড়ি-ঘোড়া বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যেভাবে যানবাহন নেমেছে, মানুষজনের সঙ্গে প্রাইভেট কারও যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আপনি দেখেন গণপরিবহন চলছে যত, তার চেয়ে প্রাইভেটকারের সংখ্যা বেশি।
রাজিব নামে এক অটোরিকশা চালক বললেন, ‘ভাই, এতদিন পর সিএনজি নিয়া বের হইছি, কিন্তু খ্যাপ পাচ্ছি না জ্যামের কারণে। ৩০০ টাকার উপরে তো ভাড়া দিতে চায় না যাত্রীরা। কিন্তু এই ভাড়ায় আপনি মালিবাগ থেকে গুলশানে গেলে দেখবেন পুরো দেড়-দুই ঘণ্টা লেগে যায়। এরকম হলে গাড়ির মালিককে দেয়ার পরে নিজের পকেটে কী বা থাকবে।’
মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর, পল্টন, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় শপিংমলগুলো খুলেছে সকালে। সকালে এসে শাটার খুলে পোশাকের দোকান পরিষ্কার করতে করতে নূর উদ্দিন শিহাব নামের এক ব্যবসায়ী বললেন, লকডাউন আমাদের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। দোকান খুলেছি, কিন্তু কোনো আশা দেখি না। করোনা পরিস্থিতির কারণে ক্রেতা সেভাবে আসবে বলে মনে হয় না। তারপরও অপেক্ষায় থাকতে হবে, এটাই ব্যবসার নিয়ম।
সাত মসজিদ রোডের একটি মার্কেটের দোকানদার মো. রফিক বললেন, ‘টানা দুই সপ্তাহ দোকান বন্ধ ছিল। আমাদের তো আয় রোজগার বন্ধ হওয়ার অবস্থা। দোকানে দুই জন কর্মচারী আছে। সামনে ঈদ, বেতন কীভাবে দেব বুঝতে পারছি না।’
অনেক দিন পর রাস্তায় নেমেছেন মোটরবাইকচালক সারওয়ার। তিনি বলেন, ‘দিন দশেক কেমনে যে চলছি সেইটা আল্লাহই ভালো জানে। আইজ রাস্তায় নামলাম। সামনে আবার লকডাউন আছে। কিছু ইনকাম করে রাখতে পারলে ভালো।’
শাহবাগে গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকা মো. আজম নামে একজন বললেন, সবকিছু তো খুলল আজ। প্রথম দিন বলেই রাস্তায় ভিড় বেশি। আমি মার্কেটে যাব, তাই গাড়ির অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষায় রয়েছি, গাড়ি পাচ্ছি না। মানুষ তো গাদাগাদি করে গাড়িতে উঠছে।