রহমত রহমান : বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬-১৭ করবর্ষে রিটার্নে প্রায় ১৮৭ কোটি টাকা শেয়ার ক্যাপিটাল বৃদ্ধিকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখিয়েছে। কিন্তু এই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বিনিয়োগের কোনো প্রমাণ পায়নি বলে আপত্তি দিয়েছে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি ওই করবর্ষে কর দেয়নি প্রায় ৬৬ কোটি টাকা।
স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির এই অনিয়ম উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘আপত্তি’ দিয়ে স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রতিবেদন দিয়েছে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদন দেয়া হয়। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের অধীন স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর এনবিআরের আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ), আয়কর ২০১৬-১৭ করবর্ষের (২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত) ওপর আয়কর নির্ধারণের সঠিকতা যাচাইয়ের ওপর নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছে, যার মধ্যে বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেডের অনিয়ম উঠে এসেছে। ওই করবর্ষে বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেডসহ ১৪টি কোম্পানির ৩৩৫ কোটি ৫৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৮৬ টাকা কর অনিয়ম উঠে এসেছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের আওতাধীন বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেডের ২০১৬-১৭ করবর্ষের হিসাব নিরীক্ষার সময় প্রতিষ্ঠানটির কর নথি, বার্ষিক নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করা হয়েছে। যাতে দেখা যায়, অননুমোদিত বিনিয়োগ করদাতার আয় হিসেবে গণ্য না করায় আয়কর ও সরল সুদ হিসেবে ৬৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ৭ টাকা কম দেখানো হয়েছে; যা প্রতিষ্ঠানটি পরিশোধ করেনি। এই কর আদায়ে বৃহৎ করদাতা ইউনিট ব্যর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সরকারি অর্থ-ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে সরকারি কোষাগারে এই আয়কর জমা হয়নি।
আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করা বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রিটার্নে শেয়ার ক্যাপিটাল বৃদ্ধি হিসেবে ওই করবর্ষে ১৮৭ কোটি ১৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দেখিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ধারা ১৯(২৪) অনুযায়ী, ওই বিনিয়োগের টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করা হয়েছে মর্মে কোনো প্রমাণপত্র আয়কর নথিতে পাওয়া যায়নি। ফলে অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ওই বিনিয়োগ করদাতার আয় হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে। এই বিনিয়োগের ওপর ৩৫ শতাংশ হারে কর প্রযোজ্য হবে; যা সুদসহ দাঁড়িয়েছে ৬৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ৭ টাকা। এই কর আদায় ও সরকারি কোষাগারে জমা নিশ্চিত করে অডিট অধিদপ্তরকে জানানোর অনুরোধ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর অডিট অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে, নিরীক্ষায় উত্থাপিত আপত্তিসহ অডিট ইস্যু নির্ধারণপূর্বক কর মামলাটি অডিটের জন্য এনবিআর হতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অডিট আপত্তির বিষয়গুলো আইনানুগ বিবেচনা করে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হবে। জবাব দিতে কয়েকবার চিঠি দেয়া হলেও একই জবাব দেয়া হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলী হোসেইন আকবর আলীর ব্যক্তিগত নাম্বারে দুদিন ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা দেয়ার পরও তিনি জবাব দেননি। এ বিষয়ে বিএসআরএম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেনগুপ্ত মঙ্গলবার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিএসআরএম কোনো অনিয়ম ও অবৈধ কাজ করে না। শতভাগ স্বচ্ছ একটি কোম্পানি। এই কোম্পানি প্রয়োজনে ব্যবসা বন্ধ করে দেবে, তবুও কোনো অবৈধ কাজ করবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অফিসিয়ালি কিছু পাইনি, সুতরাং এ বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ নেই। তবে এই রিপোর্টের কোনো ভিত্তি নেই। বিএসইসি’র অনুমোদন ছাড়া শেয়ার ক্যাপিটাল ব্যাংকিং চ্যানেলে ইস্যু বা উঠানো যায় না। সৎ ও ভালো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে অপদস্ত করার জন্য এ ধরনের রিপোর্ট করা হয়।’
বিএসআরএম গ্রুপ অব কোম্পানিজের গ্রুপ সিএফও (প্রধান অর্থ কর্মকর্তা) শেখর রঞ্জন কর এ বিষয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিএসইসি চেক জমা ছাড়া শেয়ার ইস্যু করার অনুমতি দেয় না। আমরা চেক জমা দেয়ার পর আমাদের সব কাগজপত্র দেখে অনুমোদন দিয়েছে। রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর কিছু যাচাই ছাড়া এবং না বুঝে রিপোর্ট দিয়েছে।’ টাকা জমা দেয়া-সংক্রান্ত একটি প্রমাণ দেখান তিনি।
সূত্রমতে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস কিনে নিচ্ছে তাদেরই সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম স্টিল মিলসকে। ৭ জুন বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নিয়মিত কমিশন সভায় এই বিষয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পরে বিএসইসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই অধিগ্রহণের ফলে এখন পুঁজিবাজারে অতালিকাভুক্ত বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেডের পুরো ৩৯ কোটি ৪৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪০০ শেয়ারের মালিক হয়ে যাবে প্রকৌশল খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম লিমিটেড)। এতে বিএসআরএম লিমিটেডের পরিশোধিত ?মূলধন ২৩৬ কোটি ৬ লাখ ৮২ হাজার ৩৬০ টাকা থেকে বেড়ে ২৯৮ কোটি ৫৮ লাখ ৪৬ হাজার ২৬০ টাকা হবে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিএসআরএম লিমিটেড নতুন ৬ কোটি ২৫ লাখ ১৬ হাজার ৩৯০টি শেয়ার বিএসআরএম স্টিল মিলসের মালিকদের দেবে। এর আগে তালিকাভুক্ত বিএসআরএম লিমিটেড তাদের এই সহযোগী কোম্পানিকে কিনে নিতে আবেদন করেছিল। এর প্রেক্ষিতে বিএসইসি এই অনুমোদন দেয়। এই অধিগ্রহণের ফলে এখন বিএসআরএম স্টিল মিলস নামে আর কোনো প্রতিষ্ঠান থাকবে না। এটির সব সম্পদ ও দায়ের মালিক হয়ে যাবে তালিকাভুক্ত বিএসআরএম লিমিটেড।