- ১৩৫ জন ‘বিকাশ প্রতারকের’ বাড়ি দুই ইউনিয়নের দুই গ্রামে
- ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড প্রতারণার মামলার আসামিরা জড়িত এসব অপরাধে
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্ট্রিমিং জায়ান্ট নেটফ্লিক্সের একটি ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘জামতাড়া’ যারা দেখেছেন, তাদের কাছে একটি দৃশ্য খুব পরিচিত। সিরিজটির প্রথম পর্বের প্রথম দৃশ্য ছিল-‘দুই যুবক গ্রামের একটি নির্জন স্থানে বসে একের পর এক মানুষকে বিভিন্ন ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি সেজে ফোন করছে।’ তারপর গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ক্রেডিট কার্ডের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে, এমন সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তারা মূলত প্রতারণার মাধ্যমে ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের অর্থ আত্মসাত করছিল। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের কিছু প্রত্যন্ত গ্রামে এমন প্রতারণার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। সম্প্রতি বিকাশে প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে চট্টগ্রাম ও মাগুরা থেকে দুজনকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের কাছ থেকে ডিবি ১৩৫ জন ‘বিকাশ প্রতারকের’ একটি তালিকা উদ্ধার করেছে, যাদের বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার দুই ইউনিয়নের দুই গ্রামে। অর্থাৎ শুধু মাগুরা জেলার এক উপজেলায় ১৩৫ প্রতারক অবস্থান করে বিকাশের মাধ্যমে দেশজুড়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, প্রতিদিনই মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। প্রতারকরা এমনভাবে ফাঁদ পাতে যে, গ্রাহক কিছু বুঝে ওঠার আগেই অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। অনেক সময় ‘এসএমএস’ দিয়ে ব্যালান্স যোগ হওয়াসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে সরাসরি টাকা চাওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ‘হেল্পলাইন’ থেকে ফোন করে এ্যাকাউন্ট হালনাগাদ, নতুন অফার চালুসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহককে দিয়ে কয়েকটি ‘বাটন’ চাপিয়ে কৌশলে টাকা স্থানান্তর করে নেয়া হচ্ছে অন্য এ্যাকাউন্টে। গ্রাহককে দিয়ে কিছু নম্বর চেপে মোবাইল ফোনের সিম ডাইভার্ট করে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। প্রতারণার আরও নানা কৌশল অবলম্বন করে প্রতারক চক্র। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ‘বিকাশ প্রতারণা’র শিকার হয়েছিলেন নওরিন জাহান নামে এক কলেজছাত্রী। পরবর্তীতে প্রতারণার মামলা করেন তিনি। বর্তমানে ঢাকার নি¤œ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। মামলার এজাহারে লেখা হয়েছে, একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি টেলিফোনে প্রতারণার মাধ্যমে ছাত্রীটির বিকাশ এ্যাকাউন্ট থেকে কমপক্ষে তেত্রিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পুলিশ বলছে, অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভিযুক্তদের অবস্থান জানার চেষ্টা করা হয়। মামলা করার পর পুলিশ প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দুই ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার করে। দেখা যায় দুই ব্যক্তির বাড়িই ঢাকা থেকে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার দূরবর্তী ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার একটি গ্রামে।
একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শাহরিয়ার ইমন জনকণ্ঠকে জানান, আব্বু ৬ হাজার টাকা পাঠানোর কিছুক্ষণের মধ্যে মোবাইল ফোনে ইংরেজীতে ‘বিকাশ’ শিরোনামের এক বার্তায় বলা হয়, তার এ্যাকাউন্টে ৬ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পর একটি নম্বর থেকে ফোন করে বলা হয়, ‘ভুলে আপনার এ্যাকাউন্টে ৬ হাজার টাকা চলে গেছে।’ আকুতি জানিয়ে টাকাটা ফেরত দেয়ার অনুরোধ করলে তিনি তা ফেরত দেন। পরে যাচাই করে দেখেন, তার এ্যাকাউন্টে তার আব্বু ৬ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল। পরে তিনি বুঝতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পরে নম্বরটি আর খোলা পাননি।
দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে বিকাশ প্রতারণাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের সবারই বাড়ি মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। আর ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড প্রতারণার মামলাগুলোর আসামিরা ভাঙ্গা উপজেলার বাসিন্দা। জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স-ন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) অধীনে এই বিভাগটি গঠনের পর থেকে এ ধরনের যত অভিযোগ এসেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘ভাঙ্গা পার্টি’র সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এজন্য মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ এ বিষয়ে নিয়মিতভাবেই সতর্কীকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী চালাচ্ছে। নিজেরা সতর্ক থাকলে প্রতারকরা সুবিধা করতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন।
পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম এবং মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের বহু মানুষ ডিজিটাল প্রতারণাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। পুলিশ বলছে, এদের মধ্যে ভাঙ্গার আজিমনগরে যারা কাজ করে, তারা বেশি ‘স্মার্ট’। তারা স্মার্টফোনে এমন কিছু এ্যাপ ব্যবহার করতে পারদর্শী, যেগুলো দিয়ে মোবাইলের কলার আইডি গোপন রাখা বা বদলে ফেলা যায়। এভাবে তারা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড-ডেবিট কার্ড কিংবা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তা তথ্য পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে বলে উদাহরণ আছে। তবে এরা সবচেয়ে বেশি প্রতারণা করে বিভিন্ন পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে। স্থানীয়ভাবে এরা ‘ওয়েলকাম পার্টি’ বলেও পরিচিত।
মধুখালী থানার পুলিশ বলছে, এসব এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ‘টোপ পার্টি’র কার্যক্রম। এরা মূলত বিকাশ প্রতারক। একসময়ে নানা ছলেবলে ওটিপি হাতিয়ে নেয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করা হতো মোবাইল প্ল্যাটফর্মের ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে। তবে সম্প্রতি বিকাশসহ কিছু মোবাইল প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনার পর ওটিপি হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করা কিছুটা কঠিন হয়ে গেছে। এখন এরা মূলত সম্ভাব্য শিকারদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে তাদের বিকাশ এ্যাকাউন্টে ভুলে কিছু টাকা চলে গেছে। শিকার তাদের ফাঁদে পা দিলে টাকাটা ফেরত পাঠায় এবং এক পর্যায়ে বুঝতে পারে সে প্রতারণার শিকার হয়েছে। যদিও মোবাইলে অর্থ লেনদেনের বেশ কিছু প্ল্যাটফর্ম আছে বাংলাদেশে, কিন্তু সবচেয়ে পুরনো এবং নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মটি হচ্ছে ‘বিকাশ’। বাংলাদেশে মোবাইল প্ল্যাটফর্মে অর্থ লেনদেন করে এমন প্রায় দশ কোটি গ্রাহকের অর্ধেকের বেশিই বিকাশের গ্রাহক।
জানতে চাইলে বিকাশের মুখপাত্র শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম জনকণ্ঠকে জানান, দৈনিক গড়ে যে ৭০-৮০ লাখ লেনদেন হয় তার মধ্যে খুব কমই প্রতারণামূলক লেনদেন। তিনি বলেন, প্রতারণা ঠেকাতে তাদের বড়সড় একটি দল রয়েছে যারা নির্দিষ্ট সময় পরপর সন্দেহভাজন লেনদেনগুলোর তালিকা তৈরি করে পুলিশের কাছে সরবরাহ করে। প্রয়োজনে সন্দেহজনক এ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। ঈদের সময় অর্থ লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রতারণার ঘটনাগুলোও বেড়ে যায় বলে মনে করেন তিনি। শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম আরও বলেন, যারা ধরা খান তাদের মূলত সচেতনতার অভাব রয়েছে। এসব কারণে বিস্তৃত সচেতনতামূলক কর্মসূচী রয়েছে বিকাশের, যার আকার তাদের বিজ্ঞাপন ও বিপণন প্রচারের চাইতেও বড়।