অনলাইন ব্যবসার নামে অফারের ফাঁদে ফেলে গ্রাহকের থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে টালবাহানা এখন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইন ব্যবসার সরকারি কোনো নীতিমালা না থাকায় অবাধে এসব করে বেড়াচ্ছে কিছু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম। এমনি এক প্রতিষ্ঠান ছিল ইভ্যালি। রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠে এ প্রতিষ্ঠান। বিতর্কিত সেই ইভ্যালির পথে হাঁটছে আলেশা মার্ট। গ্রাহকের ৪৫ দিনের ডেলিভারির সময় পার হওয়ার পরও অনেকে পাচ্ছেন না পণ্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত শুরু করেছে। ভোক্তা অধিকার থেকে শুরু করে প্রতিযোগিতা কমিশন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিআইডিও তদন্ত করছে। আলেশা মার্ট যে শুধু গ্রাহকের সঙ্গে এমন করছে, তা নয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যবসা শুরু করে মাত্র তিন মাসে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ৪ কোটি টাকা। এনবিআরের একটি টিম তদন্ত করে রাজস্ব ফাঁকির এসব তথ্য উদ্ঘাটন করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলেশা মার্ট ইভ্যালির মতো বাইকের অফার দিয়ে গ্রাহকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু প্রথম প্রথম দুয়েকটি পণ্য গ্রাহককে দিয়ে এর প্রচার করতে থাকে আলেশা মার্ট। এতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রাহকরা। এর পরই ডেলিভারি নিয়ে শুরু হয় সময়ক্ষেপণ ও টালবাহানা। কখনো অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে লকডাউনকে। লকডাউনে অর্থ নিলেও যত সমস্যা ডেলিভারি নিয়ে। কয়েক দিন ধরে বাইক অফারে যারা অগ্রিম অর্থ দিয়েছেন, তাদের ডেলিভারির তারিখ একের পর এক পেছানো হচ্ছে। গত ২৩ মে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড়ে বাইকের অফারে যারা অগ্রিম টাকা দিয়েছেন, তাদের বলা হয়েছিল ৪৫ দিনের মধ্যে বাইক ডেলিভারি দেয়া হবে। কিন্তু দুই মাস হলেও অনেকে বাইক বুঝে পাননি। সর্বশেষ নয়ন নামে এক গ্রাহক আলিশা মার্টের ফেসবুক গ্রুপে প্রয়োজনে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছ্ড়া দিয়েও পণ্য সরবরাহ বা টাকা ফেরতের অনুরোধ করেন। এতেও কোনো সাড়া নেই আলিশা মার্টের।
মো. আমিনুল ইসলাম বকুল নামে জামালপুরের এক গ্রাহক বাইকের জন্য টাকা দিয়েও অপেক্ষায় আছেন কবে পাবেন সেই বাইক। মো. ওয়াহিদুল ইসলাম ঢালী নামের এক গ্রাহকের বাইকও ৪৫ দিন পার হওয়ার পরও সরবরাহ করছে না আলিশা মার্ট। এমন শত শত গ্রাহক আলিশা মার্টের পণ্য বুঝে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। এদিকে আলিশা মার্টের যে ওয়েবসাইট ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে কোনো টেলিফোন বা সেলফোনের নম্বরও নেই। যে কারণে কথা বলতে চাইলেও আলিশা মার্টের ফেসবুক পেজে কমেন্ট করে বিষয়টি জানতে হয়। সবাইকে একই ধরনের সান্ত¡না দেয়া হচ্ছে, লকডাউন শেষ হলে সরবরাহ করা হবে বাইক।
এসব বিষয়ে আলিশা মার্টের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান কাজী তানজিলুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে আলিশা মার্টের চেয়ারম্যান মনজুর আলম শিকদারের বক্তব্য জানানোর অনুরোধ করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করতে পারবেন না বলে জানান তানজিলুর। পরে যোগাযোগের জন্য আলিশা মার্টের চেয়ারম্যানের টেলিফোন অথবা সেলফোন নাম্বার চাইলেও তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। আলিশা মার্টের জনসংযোগ বিভাগের এই প্রধান ভোরের কাগজকে বলেন, অনলাইন ব্যবসা-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে চেয়ারম্যান কোনো কথা বলবেন না বলেও সাফ জানিয়েছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যবসা শুরু করে আলিশা মার্ট। প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকি দিতে পারে আশঙ্কা করেন ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট কমিশনারেট উত্তরের একটি দল আলিশা মার্টের প্রিন্ট করা বিক্রয় তথ্য, বাণিজ্যিক দলিলাদিসহ ৯২ পাতার সফট কপি জব্দ করে। মূলত সঠিক রাজস্ব নির্ণয়ের জন্য ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনার এসব জব্দ করে। পরবর্তীতে এসব দলিলাদি পরীক্ষা করে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া যায়। জব্দ তালিকা যাচাইবাছাই করে দেখা গেছে, আলিশা মার্ট ২ কোটি ১৭ লাখ ১৭ হাজার টাকার বিক্রয় তথ্য গোপন করেছে। যার ভ্যাটের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬২ টাকা। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন, মার্কেটিং ব্যয়, পারচেজ ক্যাম্পেইন, কস্ট অব গুডসের তথ্যও গোপন করে আলিশা মার্ট। এভাবে ৪ কোটি ২২ লাখ ৬১ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তিন মাসের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সব মিলিয়ে ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে আলিশা মার্ট।
জানা গেছে, ইভ্যালি, আলিশা মার্ট, ধামাকাসহ ১০ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রাহকদের লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিকাশ। এর আগে বিভিন্ন ব্যাংক তাদের গ্রাহককে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্ডে লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অনলাইনে বাণিজ্যের নামে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে ঠকানোর দায়ে এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে ভোক্তা অধিকার, প্রতিযোগিতা কমিশন, সিআইডিসহ সরকারের বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা। তদন্তসাপেক্ষে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, যারা অনলাইনে ব্যবসার নামে অনিয়ম করবে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।