শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবীসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ফোনে আড়ি পাতার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে বিশ্বজুড়ে। ইসরায়েলের তৈরি হ্যাকিং সফটওয়্যার ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে বেশ কিছু দেশের সরকার এই নজরদারি চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, আনন্দবাজার।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানসহ ১৬টি সংবাদপত্র ফাঁস করেছে এই হ্যাকিংয়ের ঘটনা। তারা জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া গোপন ডাটাবেজে মিলেছে ৫০ হাজার গ্রাহকের নম্বর। যার মধ্যে রয়েছেন ভারতের কমপক্ষে ৩০০ রাজনীতিক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, বিজ্ঞানীর নাম। এ ছাড়াও বিশ্বের আরও অনেকের ফোনে আড়ি পাতার তথ্য রয়েছে। খবরে বলা হয়, ফাঁস হওয়ার এই ঘটনাটি প্রথমে জানতে পারে প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। পরে এ খবর গার্ডিয়ান, দ্য অয়্যারসহ ১৭টি সংবাদমাধ্যমের হাতে পৌঁছে। এরপর ওই দুই সংস্থা এসব গণমাধ্যমগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ তদন্ত চালায়। এই তদন্ত বা অনুসন্ধানের নাম দেওয়া হয় ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’। তাদের তদন্তেই বেরিয়ে আসে তোলপাড় করা তথ্য। তথ্য থেকে জানা গেছে, নাম ফাঁস হওয়া ব্যক্তিদের (যাদের স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল) তালিকায় রয়েছে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট, ভারতের দ্য ওয়্যারসহ বিশ্বের ১০টি দেশের মোট ১৭টি সংবাদমাধ্যম। তালিকায় থাকা ৫০ হাজার ফোন নম্বরগুলো ৪৫টি দেশের, যার ১ হাজারের বেশি নম্বর ইউরোপের দেশগুলোর। ফাঁস হওয়া এই তালিকায় বিশ্বের অন্তত ১৮০ জন সাংবাদিকের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, আলজাজিরা, ফ্রান্স ২৪, রেডিও ফ্রি ইউরোপ, মিডিয়াপার্ট, অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি), বøমবার্গ, এএফপি, ইকোনমিস্ট, রয়টার্স, ভয়েস অব আমেরিকাসহ আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক। পেগাসাস প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িত সংবাদমাধ্যমগুলো বলেছে, তারা টার্গেট করা ব্যক্তিদের তালিকা ধাপে ধাপে প্রকাশ করবে। আপাতত প্রথম ধাপে প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের ২১ দেশের নাম রয়েছে। যার মধ্যে বাহরাইন, মরক্কো, সৌদি আরব, ভারত, মেক্সিকো, হাঙ্গেরি, আজারবাইজান, টোগো, রুয়ান্ডা রয়েছে। গার্ডিয়ান জানিয়েছে, পেগাসাস ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ‘টার্গেট’ করে নিজ দেশের বিভিন্ন ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি চালাচ্ছিল- যাদের তারা হুমকি বলে মনে করে। এসব সরকার কোনো না কোনো সময় নাগরিক অথবা বিরোধী রাজনৈতিক নেতা অথবা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের ওপরে গোপন নজরদারির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে। তবে স্পাইওয়্যারটি তৈরি কোম্পানি এনএসও এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, ৫০ হাজার ফোন নম্বরের যে তালিকার কথা বলা হচ্ছে সেটি অতিরঞ্জিত। তারা শুধু বিশ্বের ৪০টি দেশের সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে স্পাইওয়্যারটি বিক্রি করেছে। উল্লেখ্য, ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান ‘এনএসও’ (ঘঝঙ) তৈরি করেছে পেগাসাস নামের ওই ম্যালঅয়্যার। যা আইফোন বা অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীর ম্যাসেজ, ছবি, ই-মেইল পাচারে সক্ষম। একই সঙ্গে কল রেকর্ড এবং গোপনে মাইক্রোফোনও চালু রাখতে পারে। ভারত : এই বিশেষ প্রযুক্তি বা স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে ভারতের তিন শতাধিক ভেরিফায়েড নম্বরে আড়ি পাতা হয়েছে বলে দাবি করেছে ‘দ্য ওয়্যার’সহ পাশ্চাত্যের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, নজরদারির তালিকায় রয়েছেন ভারতের বহু মন্ত্রী, বিরোধী নেতা, সাংবাদিক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা, বিজ্ঞানী ও সমাজকর্মী। রিপোর্টে বলা হয়েছে, দ্য হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, নেটওয়ার্ক ১৮, দ্য হিন্দু এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ বেশ কিছু বড় সাংবাদমাধ্যমের শীর্ষ স্তরের সাংবাদিকদের ফোন হ্যাক করা হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা ও বর্তমান জানিয়েছে, আড়ি পাতার তালিকায় নাম রয়েছে ৪০ জনেরও বেশি নামজাদা সাংবাদিকের। এ ছাড়া তিনজন বিরোধী নেতা। মোদি মন্ত্রিসভার দুই মন্ত্রী। দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বর্তমান ও সাবেক প্রধান এবং বহু ব্যবসায়ী। যে সমস্ত নম্বরের ওপর আড়ি পাতা হয়েছে, সেগুলো ভারতসহ ১০টি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর তথা মোদির সমালোচক সাইদ গিলানি ও সৌদি আরবের নিহত সাংবাদিক জামাল খাশোগির বান্ধবীর নম্বরও এতে রয়েছে। এই চরবৃত্তি প্রকাশ্যে আসতেই উত্তাল হয়ে উঠেছে গোটা ভারত। গত রবিবার বিজেপির রাজ্যসভার এমপি সুব্রহ্মণ্যম স্বামী ট্যুইটারে দাবি করেন, নরেন্দ্র মোদি সরকারের মন্ত্রী, আরএসএস নেতা এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ফোনে আড়ি পাততেও পেগাসাস-কে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ফোন ট্যাপ করার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সদস্যদের নিশানা করা হচ্ছে।