ইসমাইল আলী: করোনা সংক্রমণ রোধে বিশ্বব্যাপী কভিড টিকা দেয়াকে গুরুত্ব দেয়া হলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। গত দুই সপ্তাহে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ দ্রুত কভিড টিকাদান এগিয়ে নিলেও বাংলাদেশে এক্ষেত্রে গতি নেই। নিবন্ধন করলেও ক্ষেত্রভেদে টিকার এসএমএসের জন্য এক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আর টিকাদানের এ ধীরগতির জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে নেমে গেছে বাংলাদেশ। যদিও দেশে কভিডে মৃত্যু ও শনাক্ত হওয়ার হার কয়েকবার রেকর্ড ভেঙেছে গত দুই সপ্তাহে।
বর্তমানে বিশ্বের ২১৭টি দেশের মধ্যে কভিড টিকা দেয়ার হারে বাংলাদেশ ১৫৫তম অবস্থানে রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার নিচে বাংলাদেশ। যদিও দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল ১৪৫-এ, আর দক্ষিণ এশিয়ায় পঞ্চম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’ শীর্ষক গবেষণা সংস্থা এ তথ্য তুলে ধরেছে। সংস্থাটি বিশ্বের দারিদ্র্য, রোগ, ক্ষুধা, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, বাহ্যিক ঝুঁকি, অসমতা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনলাইন প্রকাশনা নিয়ে কাজ করে।
সংস্থাটির তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত বিশ্বে ৪০৭ কোটি ডোজ কভিড টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুই ডোজ দেয়া হয়েছে ১১২ কোটি মানুষের, যা বিশ্বের শতকরা ১৪ দশমিক চার শতাংশ। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে ৫১ কোটি ২৬ লাখ এবং এক ডোজ দেয়া হয়েছে ১১ কোটি ৪৫ লাখ।
কভিড টিকাদানে আনুপাতিক হারে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভুটান। দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ১৫তম। গতকাল পর্যন্ত দেশটির ৬২ দশমিক চার শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে মালদ্বীপ। দেশটিতে ৪৯ দশমিক চার শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। এতে দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ৪৪।
দক্ষিণ এশিয়ায় কভিড টিকাদানে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। গতকাল পর্যন্ত দেশটির এক কোটি সাত লাখ মানুষকে এক ডোজ এবং ২০ লাখ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। এতে বৈশ্বিক তালিকায় দেশটির অবস্থান ১২৩।
দক্ষিণ এশিয়ায় এর পরের অবস্থানে রয়েছে ভারত। এ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টিকাও দিয়েছে দেশটি। গতকাল পর্যন্ত ভারতে ৪৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষকে এক ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। আর দুই ডোজ দেয়া হয়েছে প্রায় ৯ কোটি ৯৯ লাখ মানুষকে। তবে দেশটির জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় তারা আনুপাতিকভাবে পিছিয়ে আছে। বর্তমানে দেশটির সাত দশমিক তিন শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। আর দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ১২৯।
কভিড টিকা দানের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় পঞ্চম ও বৈশ্বিক ১৩৯তম অবস্থানে রয়েছে নেপাল। দেশটির পাঁচ দশমিক চার শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানে। দেশটিতে এক ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে দুই কোটি ৭৯ লাখ মানুষকে। আর দুই ডোজ দেয়া হয়েছে ৫৯ লাখ মানুষকে। টিকা দেয়ার হার দুই দশমিক সাত শতাংশ। এতে বৈশ্বিক তালিকায় দেশটির অবস্থান ১৫৪।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বশেষ ও বৈশ্বিক তালিকায় ১৫৫তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল পর্যন্ত এক ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে এক কোটি ১২ লাখ মানুষকে ও দুই ডোজ দেয়া হয়েছে ৪৩ লাখ মানুষকে। টিকাদান সম্পন্নের হার দুই দশমিক ৬ শতাংশ।
কভিড টিকা দানের তালিকায় বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত একক টিকার উৎসের ওপর নির্ভর করায় পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। কারণ ভারত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় অনেকেই দ্বিতীয় ডোজ টিকা দিতে পারছেন না। আবার চীন থেকে কেনা টিকা ও কোভেক্স চুক্তির আওতায় অনুদানের টিকা পেতে দেরি হওয়ায় দুই মাসের বেশি সময় গণটিকা দান কর্মসূচি বন্ধ ছিল। ফলে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, আজ ও বুধবার অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১২ লাখ ডোজ টিকা অনুদান হিসেবে পাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে ঝুলে থাকা দ্বিতীয় ডোজ দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে। পাশাপাশি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মডার্নার ও সিনোফার্মার টিকা এক কোটি ডোজ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে দ্রুত এ তালিকায় এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
যদিও কভিড টিকাদানের তালিকায় বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সঠিক পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, টিকা দেয়ার বয়স কমিয়ে ৩৫, ৩০ ও সর্বশেষ ২৫ বছর করা হয়েছে। বলা হচ্ছে দ্রুতই তা ১৮ বছর করা হবে। কিন্তু টিকা দেয়ার গতি অনেক কম। দৈনিক পাঁচ লাখ নিবন্ধন করলেও টিকা দেয়া হয় দুই লাখ ডোজ। এতে অনেকে নিবন্ধনের ১৫-২০ দিনেও এসএমএস পাচ্ছে না। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কভিড টিকাদান কার্যক্রমে গতি আনার বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে ২৭ জানুয়ারি এক ডোজ টিকা দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে শুরু হয় কভিড টিকা দেয়ার কর্মসূচি। প্রথম দিনে পরীক্ষামূলকভাবে মোট ২৬ জনকে টিকা দেয়া হয়। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি গণটিকা দেয়া শুরু হয়। এতে গত এপ্রিলে টিকার সুযোগ পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় জায়গা হয় বাংলাদেশের। তবে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দিলে ২৬ এপ্রিল গণটিকা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। এদিকে কোভ্যাক্স থেকে পাওয়া অনুদানের টিকা (ফাইজার ও মডার্না) এবং চীনের সিনোফার্মার অনুদান ও কেনা টিকা সরবরাহ শুরুর পর গত ১ জুলাই থেকে আবারও গণটিকা দান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কভিশিল্ড সরবরাহ বন্ধ থাকায় প্রায় ১৩ লাখ মানুষ দ্বিতীয় ডোজ দিতে পারছে না। যদিও সম্প্রতি কোভ্যাক্সের আওতায় জাপান ২৫ লাখ ডোজ কভিশিল্ড টিকা অনুদান হিসেবে দিতে সম্মত হয়েছে, যার মধ্যে ১৩ লাখ ডোজ চলতি সপ্তাহে আসছে। এরপর আবার দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়া শুরু করা হবে।