জয়নাল আবেদিন: এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। তবে তিন মাসের হিসাবে বৃদ্ধির পরিমাণ আরও বেশি। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ২৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। মেয়াদি ও চলতি দুই ধরনের ঋণের মধ্যে মেয়াদি ঋণে সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে না পারা ঋণ বৃদ্ধির হার ৩৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, মাত্র তিন মাসে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ২৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক খেলাপিতেও। কারণ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি বৃদ্ধি পেয়েছে ছয় হাজার ৮০২ কোটি টাকা। তবে মার্চ শেষে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় খেলাপি বেড়েছে দুই হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। একই সময় শিল্প খাতে সার্বিক মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ১৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেড়ে ৯৮ হাজার ৯০৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা বড় ঋণ শিল্প খাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ রকম হয়েছে বলে জানা গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণভাবে বড় শিল্পের মালিকদের অনেকে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশসহ নানা সুবিধা নিয়ে খেলাপি দেখানো থেকে বিতরণ থাকেন। ফলে অন্য খাতের তুলনায় শিল্পের ঋণ খেলাপি কম হয়। এর পরও সামগ্রিক খাতের তুলনায় শিল্প খাতে খেলাপি ঋণের হার অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, একটি বড় ঋণখেলাপি হলে তার প্রভাব অনেক বেশি। এ কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে কেন্দ ীয় ব্যাংক। যদিও বেশি মুনাফার সুযোগের ফলে ব্যাংকগুলো বরাবরই বড় শিল্পে ঋণ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে শিল্প খাতে মোট ৯০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিতরণ কমেছে ৬৯৫ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ। বিতরণ করা শিল্প ঋণের মধ্যে ৭৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা বা ৮০ দশমিক ২৯ শতাংশ বিতরণ হয়েছে বড় শিল্পে। মাঝারি শিল্পে বিতরণ হয়েছে ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশ, অংকে যার পরিমাণ ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ক্ষুদ্র শিল্পে বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বা আট হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিতরণকৃত এসব ঋণের মধ্যে মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। আর চলতি মূলধন হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে ৭৩ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।
কেন্দ ীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২০ সালের মার্চ শেষে শিল্প ঋণের মোট মেয়াদোত্তীর্ণের পরিমাণ ছিল ৮৫ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। আলোচ্য সময়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৮ হাজার ৯০৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। শিল্পঋণে মোট মেয়াদোত্তীর্ণের পরিমাণ বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৩৬, আট দশমিক ২৭ ও সাত দশমিক ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পঋণের মোট বকেয়া পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৃহৎ শিল্পে ৭৭ দশমিক ৬৯, মাঝারি শিল্পে ১৪ দশমিক ২৭ এবং ক্ষুদ্র শিল্পে বকেয়ার হার আট দশমিক শূন্য চার শতাংশ। হিসাব করে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে শিল্পঋণে বকেয়ার পরিমাণ আট দশমিক ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। খাতভিত্তিক বিবেচনায় বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে যথাক্রমে পাঁচ দশমিক ৯৮, ২৭ দশমিক শূন্য সাত ও এক দশমিক ১১ শতাংশ বকেয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ শেষে মেয়াদি শিল্পঋণের বকেয়া স্থিতি ছিল দুই লাখ ৬৬ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। এক বছর পর অর্থাৎ চলতি বছরের মার্চে তা ১২ দশমিক ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দুই লাখ ৯৯ হাজার ৪৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অন্যদিকে চলতি মূলধন ঋণে বকেয়া চার দশমিক ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৯৭ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশের শিল্প খাতসহ পুরো অর্থনীতি এখন করোনায় ভুগছে। অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ। বড় কিছু শিল্প ছাড়া সবাই বিপদে রয়েছে। এ সময় আয় ও মুনাফা বন্ধ থাকায় তারা ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারেনি। ভালো সময়ের জন্য এখন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, একাটি বৃহৎ ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে পুরো ব্যাংক খাতের ওপর এর প্রভাব পড়ে। শিল্প খাতে বড় ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।