বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট ফাঁকির মহামারি

বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট ফাঁকির মহামারি

ফারুক মেহেদী

সাবধান, আপনি চমকে উঠতে পারেন! জানেন কি, এখন পর্যন্ত ভ্যাটের কত টাকা ফাঁকি দেওয়া হয়েছে? জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের গত মে মাস পর্যন্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, এর পরিমাণ ২০ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। আর ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার তালিকায় কে নেই—দেশের বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, আমদানি-রপ্তানিকারক, বিক্রেতা—সবাই। অথচ সাধারণ ভোক্তারা ভ্যাট বাবদ তাঁদের টাকা ব্যবসায়ী বা বিক্রেতাদের দিয়ে দিয়েছেন।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা এই বিপুল অঙ্কের টাকা আদায়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ ও জড়িতদের চাপে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।

অনাদায়ি ভ্যাটের পরিমাণ পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই টাকায় করোনার টিকা কোভিশিল্ডের ৫০ কোটি ৩৮ লাখ ডোজের বেশি টিকা কেনা যেত (প্রতি ডোজের দাম ৫ ডলার বা ৪৯২ টাকা ধরলে)। অথবা কর্ণফুলী নদীতে নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো আরও দুটি টানেল বানানোর পরও কমপক্ষে ৬ হাজার কোটি টাকা থেকে যেত।

এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ ক্ষেত্রে এনবিআরের কাজ হচ্ছে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে টাকা আদায় করা। আলোচনার মাধ্যমেও আদায়ের কাজ করা যায়। যারা ভালো কোম্পানি, তাদের কাছ থেকে চাপ দিয়ে বা আলোচনা করেও বকেয়া টাকা আদায় করে নেওয়া যায়। শীর্ষ ভ্যাটদাতা যারা ফাঁকি দিয়েছে, তাদের কারও কারও হয়তো দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, তবে মামলায় যাওয়ার মতো নয়।

এমন ক্ষেত্রেও আলোচনা করে আদায় করা যেতে পারে। আর দোকানদারেরা তো এমনিতেই ভ্যাট দেওয়ায় পিছিয়ে। তাঁদের জন্য ইএফডি দেওয়া যায়। এটা দিলে সবাইকে দিতে হবে। কাউকে দিয়ে, কাউকে না দিয়ে পুরো ভ্যাট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর ইএফডি দিলেও তা নজরদারি করতে হবে।

এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ফাঁকির শীর্ষে রয়েছেন দেশসেরা ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এরা সংখ্যায় ১৭০। ভ্যাটের বৃহৎ করদাতা ইউনিট–এলটিইউয়ের আওতায় ভ্যাট দেয়। এই ১৭০টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে ফাঁকি দিয়েছিল ১০ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। তবে এদের অনেকে ফাঁকি ধরা পড়ার পর একটি অংশ জমা দিয়েছে। এখনো তাদের কাছে পাওনা ৭ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। এ বিষয়ে এনবিআরের ভ্যাট শাখার সাবেক সদস্য আবদুল মান্নান পাটোয়ারী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রথম থেকেই ভ্যাট দেওয়ার ব্যাপারে ভ্যাটদাতারা উদাসীন। এখন সরকার যে ইলেকট্রনিক ফিশকল ডিভাইস দিতে যাচ্ছে, এটা বাস্তবায়ন করা হলে ভ্যাট ফাঁকি অনেকাংশে কমে যাবে। এনবিআর নিয়মিত তদন্ত করে যারা ফাঁকি দেয় তাদের ধরতে পারে। ফাঁকির দিক থেকে শীর্ষরাই এগিয়ে। বিশেষ করে ব্যাংকসহ করপোরেট প্রতিষ্ঠান।’ তিনি বলেন, নানা কারণে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সেবার ওপর কাটা ভ্যাটের টাকা ঠিকমতো সরকারি কোষাগারে জমা দেয় না। পরে তদন্ত করলে এগুলো ধরা পড়ে। আগে এ ধরনের ত্রুটি আরও বেশি ছিল, এখন নিয়মিত তদন্ত কার্যক্রম বাড়ানোর ফলে তা কমে আসছে।

Captureএনবিআরের তথ্য আরও বলছে, ভ্যাট ফাঁকিতে শীর্ষ ভ্যাটদাতাদের পরই রয়েছেন রাজধানীর দক্ষিণ সিটি এলাকা, বিশেষ করে পুরান ঢাকা, মতিঝিল, তেজগাঁও, ধানমন্ডি এবং নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। এঁরা এ পর্যন্ত ফাঁকি দিয়েছেন ৬ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাও ফাঁকিতে পিছিয়ে নেই। চট্টগ্রাম বন্দর, পাইকারি ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জসহ এই শিল্পাঞ্চলের কমিশনারেটের আওতায় ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। এরপরেই আছে রাজধানী গুলশান এবং টঙ্গী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। ঢাকা উত্তর কমিশনারেটের আওতায় তাঁদের ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের পরিমাণ ১ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, নরসিংদী, ঘোড়াশালের ব্যবসায়ীরা ঢাকা পূর্ব কমিশনারেটের আওতায় ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছেন ১ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল তথা মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সাভার, আশুলিয়া, মানিকগঞ্জের ব্যবসায়ীরা ফাঁকি দিয়েছেন ৩৪৮ কোটি টাকা।

এ ছাড়া কুমিল্লা অঞ্চলে ৭৩৯, সিলেটে ১০৩, খুলনায় ২৭৪, যশোরে ১৪১, রাজশাহীতে ২০৪ ও রংপুরে ৫১ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে এনবিআর। ঢাকার শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তরের আওতায় ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়েছে ৯৩ কোটি টাকা।

ভ্যাট ফাঁকি ধরায় নিয়োজিত এনবিআরের বিশেষায়িত দপ্তর নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরও ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানা যায়, তারা গেল এক বছরে ১৯৩টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়েছে।

এ বিষয়ে সংস্থার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, ‘আমাদের অভিযানে বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির তথ্য থেকেই বোঝা যায় ফাঁকি ধরার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যেখানেই ফাঁকির সন্দেহ হয় সেখানেই আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।’ তিনি বলেন, ‘ভ্যাট কারও নিজের টাকা নয়। এটা ভোক্তার অংশ, যা সরকারের খাতায় জমা দেওয়ার কথা।

তার পরও আমরা দেখি একটি বড় অংশ ফাঁকি হয়ে যাচ্ছে। তার মানে ব্যবসায়ী ও আদায়কারীর মধ্যে একটা ফাঁক রয়েছে। এটা আমরা কমিয়ে আনতে চাই।’

অর্থ বাণিজ্য