ইভ্যালি   নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হলে  বন্ধ হতে পারে

ইভ্যালি নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হলে বন্ধ হতে পারে

এম শাহজাহান ॥ ভোক্তা স্বার্থ নিশ্চিত করতে সরকারের ডিজিটাল কমার্স নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হলে বিতর্কিত ইভ্যালির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করা হতে পারে। এই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গ্রাহক টাকা পরিশোধে এলাকাভেদে ৫-১০ দিনের মধ্যে পণ্য বুঝে পাবেন। ইভ্যালির বর্তমান কার্যক্রম, গ্রাহকসেবা এবং আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে সরকার। আজ বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে অনলাইন মার্কেট প্লেস ইভ্যালির ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কারণ দর্শানোর নোটিসের পরিপূর্ণ জবাব যথাসময়ে দাখিল করতে পারেনি ইভ্যালি। এছাড়া দেশের লাখ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয়া হলেও তাদের পণ্য ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে না। এ ধরনের শত শত অভিযোগ পড়েছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরে। একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ও প্রতিযোগিতা কমিশনে প্রতিকার চেয়েও অনেকে আবেদন করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে ইভ্যালির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

জানা গেছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে ইভ্যালি গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত কত টাকা নিয়েছে, মার্চেন্টদের কত টাকা পরিশোধ করেছে এবং গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনার পরিমাণ ও তা পরিশোধে ইভ্যালির পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হলেও নির্ধারিত সময়ে কোম্পানিটি সেসব তথ্য জানায়নি। ইভ্যালি গ্রাহক ও মার্চেন্ট পর্যায় থেকে যে চারশ’ কোটি টাকা নিয়েছে তা কোথায় রাখা হয়েছে- এসব বিষয়ও জানতে চাওয়া হয়। কোন তথ্য না দিয়ে কোম্পানিটি এসব তথ্য জানাতে বরং আরও ৬ মাস সময় চেয়েছে। ইভ্যালির প্রস্তাব অনুযায়ী তথ্য সরবরাহের জন্য তাদের সময় দেয়া হবে কি-না এবং সময় না দিয়ে অন্য কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, সেসব বিষয় আলোচনা করে আজকের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি। বৈঠকে কোম্পানিটির ব্যাপারে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক মোঃ হাফিজুর রহমানকে প্রধান করে সম্প্রতি ইভ্যালির ভবিষ্যত নির্ধারণে ৯ সদস্যের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মূলত এই কমিটি আজ বুধবার বেলা ৩টায় বৈঠক করে ইভ্যালির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও প্রতিযোগিতা কমিশনের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। এছাড়া কমিটিতে রয়েছেন কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী তানজীব উল আলম। কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে ইভ্যালির ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলোচনা প্রভৃতি।

তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার নির্দেশিকার বাইরে গিয়ে ইভ্যালিকে ব্যবসা করার কোন সুযোগ দেয়া হবে না। কোম্পানিটি নির্দেশিকা অমান্য করে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এর আগে এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি) কোম্পানি যুবক ও ডেসটিনিসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির ফাঁদে পড়ে লাখ লাখ গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ইভ্যালির মতো কোম্পানিগুলোকে এখনই নিয়ন্ত্রণ বা আইনী কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হলে দেশের কোটি কোটি মানুষ এক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এর আগে গত ৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ইভ্যালির বিষয়ে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার অধিদফতরসহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি পাঠানো হয়।

এ প্রসঙ্গে ইভ্যালির বিষয়ে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রধান মোঃ হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নীতিমালার নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের দেশে ব্যবসায় করার সুযোগ নেই। ইভ্যালি কোম্পানির পুরো বিষয়টি সরকারের বিভিন্ন পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা যাচ্ছে। মূল কথা গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা করা হবে। কোম্পানিটির পক্ষ থেকে সময় চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। আজকের বৈঠকে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। তিনি বলেন, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনার নির্দেশনায় বলা হয়েছে- এমএলএম কোম্পানির মতো নেটওয়ার্ক ব্যবসায় পরিচালনা করা যাবে না। এছাড়া বিক্রির জন্য প্রদর্শিত পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা পণ্যসামগ্রী ডেলিভারিম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার নিকট হস্তান্তর করতে হবে। এছাড়া ক্রেতাকে টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাতে হবে। এছাড়া ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে বা গ্রামে অবস্থান করলে ক্রয়াদেশ গ্রহণের পরবর্তী সর্বোচ্চ পাঁচদিন এবং ভিন্ন শহর বা গ্রামে অবস্থিত হলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি করার বিধান রাখা হয়েছে। এসব নির্দেশিকার বাইরে গিয়ে ইভ্যালি ব্যবসা করতে পারবে না।

উল্লেখ্য, গত জুন মাসে ইভ্যালির আর্থিক অনিয়ম নিয়ে এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ১৪ মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিটি গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৪ কোটি টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ করেনি। আবার মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ১৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ইভ্যালির চলতি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ইভ্যালির পুরো সম্পদ দিয়ে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনার মাত্র ১৬ ভাগ পরিশোধ করা সম্ভব। এসব তথ্য ইভ্যালিই বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সরবরাহ করেছে জানিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইভ্যালির প্রকৃত দায়-দেনার পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। এর প্রেক্ষিতে গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছে, কত টাকার পণ্য গ্রাহকদের ডেলিভারি করেছে, মার্চেন্টদের কত টাকা পরিশোধ করেছে এবং গ্রাহক ও মার্চেন্টদের বকেয়া পরিশোধের পরিকল্পনা ১ আগস্টের মধ্যে জানাতে কোম্পানিটিকে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ১ আগস্ট ইভ্যালি ফিরতি চিঠি দিয়ে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ৬ মাস সময় চেয়েছে।

ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য দেয়ার নির্দেশ মানা হচ্ছে না ॥ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালিকে ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতি অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করা পণ্য একই শহরের মধ্যে হলে সর্বোচ্চ পাঁচ দিনের মধ্যে এবং ভিন্ন শহর বা গ্রামে হলে ১০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রাসেলের কাছে পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক-১ এস এম নাজিয়া সুলতানা স্বাক্ষরিত চিঠিতে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ও জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা সঠিকভাবে মেনে ব্যবসা পরিচালনা করারও নির্দেশনা রয়েছে চিঠিতে। পুলিশ সদর দফতরের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে ইভ্যালির বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করার তথ্য উঠে আসার পর এ চিঠি পাঠালো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান দুটি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো লঙ্ঘনের দায়ে তিন বছর পর্যন্ত কারা দণ্ডাদেশের বিধান রয়েছে।

তথ্য প্রুযুক্তি