আনোয়ার হোসেন
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলে নেতাদের এই মনোভাবের কথা জানা গেছে। দলীয় সূত্র বলছে, ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভিন্ন সময় এ ধরনের অভিযান চালিয়েছে সরকার। প্রতিটি অভিযানের শুরুতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। দু-একজন আলোচিত চরিত্র ধরা পড়ে। কিন্তু যারা ধরা পড়ে, তাদের পৃষ্ঠপোষক বা পেছনের শক্তিকে ধরার দাবি জোরালো হলে অভিযান থেমে যায়।
২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অপরাধের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে। চলে মাস দেড়েক। তখন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের মাঝারি কিছু নেতার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার তথ্য বেরিয়ে আসে। গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট ও ঠিকাদার জি কে শামীমসহ ১২-১৩ জনকে। তাঁদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কোনো কোনো বড় নেতার নামও আলোচনায় আসে। পরে ওই অভিযান আর এগোয়নি।
এরপর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আলোচনায় আসেন নরসিংদী যুবলীগের তৎকালীন জেলা সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া। তিনি গ্রেপ্তার হলে পাঁচ তারকা হোটেলে বসে তাঁর নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা প্রকাশ পায়। তাঁকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন তাঁকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার পেছনে নরসিংদী ও ঢাকার বর্তমান ও সাবেক তিন সাংসদ এবং কেন্দ্রীয় কোনো কোনো নেতার নাম আলোচনায় এসেছিল। সেই অভিযানও পাপিয়া ও তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। কিন্তু পাপিয়ার উত্থান এবং অপকর্মে সহায়তাকারী কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালায়। অভিযোগ যত দিন থাকবে, তত দিন চলবে।
আসাদুজ্জামান খান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
সম্প্রতি ফেসবুকে ‘চাকরিজীবী লীগ’ ও ‘নেতা বানানোর’ ঘোষণা দিয়ে ছবি পোস্ট করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। এরপর তাঁকে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে গ্রেপ্তার হন ‘দরজি মনির’ নামে খ্যাত মো. মনির খান। তিনি ‘বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনের সভাপতি। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় কথিত মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ এবং চিত্রনায়িকা পরীমনি, প্রযোজক নজরুল রাজসহ আরও কয়েকজনকে। সবার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে মদ ও মাদক রাখার অভিযোগে মামলা হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, প্রভাবশালী ও বিত্তবানদের নানাভাবে ‘ব্ল্যাকমেল’ বা ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করাই তাঁদের মূল অপরাধ। যদিও কোন কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি বা কারা এঁদের ফাঁদে পড়েছিলেন, সেটা প্রকাশ করেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সত্যতা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও নানাভাবে কিছু কিছু নাম আলোচিত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, পরীমনি, পিয়াসা, নজরুল রাজসহ বিনোদনজগতের যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা ভুঁইফোড় সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাঁদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কথাও শোনা যায় না। তবে তাঁরা রাজনীতিক, সরকার ও সমাজের প্রভাবশালী কারও কারও সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন—এমন আলোচনা আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান আর ভুঁইফোড় সংগঠনের দিকে নেই। ফলে এই দফার অভিযান আর এগোবে কি না, সেটা নিয়ে নেতারা সন্দিহান।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও। তিনি গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অভিযান শুরু করে আবার হঠাৎ বন্ধে হয়ে গেছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালায়। অভিযোগ যত দিন থাকবে, তত দিন চলবে।’ প্রভাবশালীদের নাম এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘সবার জন্য আইন সমান। ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ নেই।’
তবে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এবারের অভিযানের পর বলা হচ্ছে, পরীমনি ও পিয়াসাদের চক্র বাসায় মদ ও মাদকের আসর বসাত, তাতে প্রভাবশালী ও বিত্তবানদের যাতায়াত ছিল। তাঁদের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে পরবর্তী সময়ে ব্ল্যাকমেল বা প্রতারণা করা হতো। প্রভাবশালীদের নাম আসার অর্থ হচ্ছে—এই অভিযান আর এগোবে না। অতীতেও সব অভিযান শেষ হয়েছে প্রভাবশালীদের নাম আসার পর।
এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতাদের একটা অংশ মনে করে, অভিযানের মূল লক্ষ্য পরিষ্কার করা উচিত। এরপর চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে—এমন একটা বার্তা থাকা দরকার। আরেকটা অংশ মনে করে, এ ধরনের অভিযানে অপরাধের মূল উৎপাটনের চেয়ে ব্যক্তির চরিত্রহনন হয় বেশি। তাই শুরুতে মানুষের বাহবা পেলেও আস্তে আস্তে অভিযানের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ভুঁইফোড় সংগঠনের যেসব নেতা সরকার বা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তাঁরা জানিয়েছেন। দলের কোনো পর্যায়ে তাঁদের সম্পৃক্ততা থাকলে সেখান থেকেও বাদ দেওয়া হচ্ছে।
বিনোদনজগতের ব্যক্তিদের আটকের বিষয়ে সরকারি দলের এই নেতার মতে, সমাজের কোনো অবস্থানে থেকে কেউ যদি অবক্ষয় সৃষ্টি করে, অপকর্ম করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা ইতিবাচকভাবেই তিনি দেখছেন। এই অভিযান কত দিন চলবে, কতটুকু চলবে, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঠিক করবে।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র বলছে, প্রতিবার অভিযান শুরুর পেছনে কিছু কারণ থাকে, যা প্রকাশ হয় না। তবে দলের নেতাদের ধারণা, গুরুত্বপূর্ণ কোনো রাজনীতিক কিংবা আমলা ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে অভিযানের বিষয়টি সামনে আসে। আগস্ট মাস আওয়ামী লীগের জন্য শোকের মাস। এই মাসে দলীয়ভাবে বা সরকার নিতান্ত প্রয়োজন না হলে এ ধরনের অভিযানে সায় দেয় না। এবারও হয়তো পেছনে বড় কোনো কারণ থাকতে পারে। তাই প্রথা ভেঙে এই অভিযান শুরু করা হয়েছে।
শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া দৃশ্যত অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। আর অপরাধীরা সব সময় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠে। সরকার বিপদে বা সমালোচনায় পড়লে তাদের ধরে। জোড়াতালির সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করে। মানুষ ভুলে গেলে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। তিনি বলেন, প্রভাবশালীরা ধরা পড়বেন না—এটাও স্বাভাবিক। কারণ, প্রভাবশালীদের জবাবদিহি করার যে উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং উন্নত চরিত্রের রাজনীতিক দরকার, তা নেই।