- অনলাইন কেনাকাটায় সতর্ক থাকার বিষয়ে প্রচার চালানো হবে
এম শাহজাহান ॥ এমএলএম কোম্পানির আদলে ই-কমার্স ব্যবসা করার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। তথ্যমতে, বিতর্কিত ইভ্যালির বাণিজ্যিক কার্যক্রম অনেকটা দেশে নিষিদ্ধ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম কোম্পানির মতো নেটওয়ার্কিং ব্যবসা। এ ধরনের ব্যবসায় গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি প্রায় শতভাগ। এর আগে ডেসটিনি ও যুবকসহ যেসব কোম্পানি এমএলএম ব্যবসা করেছিল সেখানে গ্রাহকরা বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন। অসহায় গ্রাহকরা টাকা ফেরত পাননি। ইভ্যালির প্রতারণার বিষয়টি এতটাই জটিল যে, গ্রাহকদের ২ হাজার ৬১২টি মামলার নিষ্পত্তি করতে পারছে না জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। তবে টাকা ফেরত পেতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের দ্রুত মামলা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, ই-কমার্স ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে দেশে কে বা কারা নিষিদ্ধ এমএলএম ব্যবসা করছে তাদের ব্যাপারে বিশদ খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শতাধিক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। শীঘ্রই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ইভ্যালিসহ অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শীঘ্রই গ্রাহকদের সতর্ক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী প্রচার চালানো হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, মহামারী করোনার এই সময়ে কোন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী প্রতারণার মাধ্যমে যেন ফায়দা লুটতে না পারে সেজন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইভ্যালিসহ ই-কমার্স ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে কি হচ্ছে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। করোনার এই দুঃসময়ে গ্রাহক ঠকিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে সরকার বিরোধী বিএনপি-জামায়াত বা অন্যকোন রাজনৈতিক শক্তি এর পেছনে কাজ করছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি যুবকসহ কয়েকটি কোম্পানির ফাঁদে পড়ে দেশের লাখ লাখ গ্রাহক ইতোপূর্বে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারীভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও ডেসটিনি ও যুবকের গ্রাহকেরা এখনও টাকা ফেরত পাননি। কোম্পানিগুলোর সম্পদের তুলনায় দায়দেনা কয়েকগুণ বেশি। অভিযোগ আছে ডেসটিনি, যুবক ও ইভ্যালির কর্মকর্তারা দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সেলের প্রধান মোঃ হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ইভ্যালির যেসব গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন তারা যেন দ্রুত ভোক্তা অধিদফতরে মামলা করেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হবে। তিনি বলেন, এমএলএম কোম্পানি আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই এমএলএমের আদলে ই-কমার্স ব্যবসা করার কোন সুযোগ নেই। ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতিদিন মামলা হচ্ছে। আড়াই হাজারের বেশি মামলা স্পর্শকাতর। এগুলো এখনও নিষ্পত্তি করা যায়নি।
জানা গেছে, ই-কমার্সের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সঠিকপণ্য সময়মতো পৌঁছানো। কিন্তু ইভ্যালি এই কাজটি করতে পারছে না। টাকা আটকে রেখে ইভ্যালি গ্রাহককে জানিয়ে দিচ্ছে পণ্যের সরবরাহ নেই বলে অর্ডার বাতিল করা হলো। এছাড়া কোম্পানিটি গিফট কার্ড দেয়ার নামে প্রতারণা করছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ৪৫ ধারায় বলা আছে, প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ করা না হলে অনুর্ধ এক বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। এ প্রসঙ্গে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম বলেন, ইভ্যালির কার্যক্রমের ধরন অনেকটা এমএলএম কোম্পানির মতো। এমএলএম কোম্পানির প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা দেখে মনে হচ্ছে, ইভ্যালিও তাই করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে মানিলন্ডারিং হচ্ছে। এদিকে, গত ১৪ মার্চের এক হিসাব অনুযায়ী, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে মোট ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৪ টাকা দায়ের বিপরীতে ইভ্যালির কাছে মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা চলতি সম্পদ ছিল। দেড় মাসের মধ্যে গ্রাহকের হাতে পণ্য বুঝিয়ে দেয়ার কথা বলে অগ্রিম এসব টাকা নিয়ে রেখেছে ইভ্যালি। এই পরিস্থিতিতে বছর পর হয়ে গেলেও তারা পণ্য দিতে পারছে না।
জানা গেছে, ২০০২ সালে ডেসটিনিসহ দেশে বহুস্তর বিপণন ব্যবস্থা বা এমএলএম কোম্পানি ছিল ১৬টি। ২০০৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪টিতে। বর্তমানে দেশে শতাধিক এমএলএম কোম্পানি কাজ করছে। দীর্ঘ ৮ বছর আগে এসব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনের খসড়া তৈরি হলেও লাইসেন্স দেয়া হয়নি কোন প্রতিষ্ঠানকে। অর্থাৎ দেশে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা একেবারেই নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রতারণার ধরন পাল্টে ই-কমার্স, ই-বিজনেস ও ডিরেক্ট টেলিমার্কেটিং, ক্যাশলেস সোসাইটি প্রভৃতি নামে বিভিন্ন ‘এমএলএম কোম্পানি’ গড়ে উঠেছে। কোন কোন কোম্পানি ফুড সাপ্লিমেন্ট, প্রসাধনসামগ্রী ও হারবাল ওষুধ বিপণনের নামে বেশ কিছু ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান এমএলএম ব্যবসার নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানেও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি কারাগারে বসেই জুম এ্যাপে সহযোগীদের সঙ্গে মিটিং করার অভিযোগ উঠেছে এক সময়কার আলোচিত এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমিনের বিরুদ্ধে। খুলেছেন নতুন এমএলএম কোম্পানি।
এমএলএম ব্যবসা করতে পারবে না ইভ্যালিসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ॥ দেশে নিষিদ্ধ এমএলএম ব্যবসা করতে পারবে না ইভ্যালি, দারাজের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। পণ্য বা সেবা বিক্রয় বা প্রসারের জন্য কোন ধরনের লটারি বা এ জাতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। এমন কি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যতীত কোন ভার্চুয়াল ওয়ালেটও তৈরি করতে পারবে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশনায় বলা হয়েছে- ক্রেতা এক শহরে থাকলে সর্বোচ্চ ৫ দিন এবং ভিন্ন শহরে থাকলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি করতে হবে। আর বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই পণ্য ডেলিভারি ম্যানের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। একই সঙ্গে ক্রেতাকে সেটি টেলিফোন, ইমেল বা এসএমএসের মাধ্যমে অবহিত করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ডেলিভারির সময় আরও সংক্ষিপ্ত করতে হবে। একই সঙ্গে গৃহীত ক্রয়াদেশে একাধিক পণ্যের জন্য আলাদা আলাদা ডেলিভারি চার্জ আরোপ করা যাবে না। নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, পণ্য বিক্রির জন্য কোন ধরনের অফার, ডিসকাউন্ট, ফ্রি ডেলিভারি বা অন্য কোন সুবিধা থাকলে তা পরিষ্কারভাবে পণ্যের বর্ণনায় থাকতে হবে। বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্য বিক্রেতার নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে এবং কী পরিমাণ পণ্য স্টকে আছে তা উল্লেখ করতে হবে। কোন ধরনের নকল বা ভেজাল পণ্য প্রদর্শন বা বিক্রয় করা যাবে না। পণ্য বা সেবার বিষয়ে অভিযোগের জন্য মার্কেট প্লেস, এ্যাপ বা প্ল্যাটফরমে ফোন নম্বর, ইমেল বা অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম সঠিকভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। পণ্যের ব্যাপারে রেটিং এবং মতামত জানানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।