মিজান মালিক
ভয়ঙ্কর ঋণ জালিয়াতিতে জড়িত হলমার্কের ১১ মামলার বিচার শুনানিতে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। বেরিয়ে এসেছে জালিয়াতির নীলনকশার আদ্যোপান্ত। চক্রটি ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করতে হোটেল শেরাটনের (বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) পাশে সাকুরার পেছনে একটি ব্যক্তিগত বাড়ি ভাড়া নেয়। সেখানেই চলত জালজালিয়াতির কাগজপত্র তৈরিসহ সব ধরনের কারসাজির কাজ।
ওই বাড়িতে হলমার্কের লোকজনই জালিয়াতিতে ব্যবহৃত ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দিত। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই ছাড়াই সেই কাগজপত্রে সই-স্বাক্ষর করে টাকা বের করে দেওয়ার সুযোগ করে দেন। এভাবেই চলছিল লুটপাট। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা ‘উচ্চঝুঁকি’ নিয়েই হলমার্ককে টাকা আত্মসাতের ব্যবস্থা করে দেন। অন্যদিকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা বিদেশে পালিয়ে থাকা সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবিরকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, যেসব কারখানার ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ঋণের নামে হলমার্ক গ্রæপ সোনালী ব্যাংক থেকে ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করেছে, সেসব কারখানায় যন্ত্রপাতির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, হলমার্ক গ্রæপের প্রায় সবগুলো কারখানাই সাভার এলাকায়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৪০টি কারখানাই বন্ধ রয়েছে। কারখানার ভঙ্গুর অবকাঠামো ছাড়া এখন আর তেমন কিছুই নেই। এসব কারখানাসহ হলমার্কের স্থাবর সম্পদ ক্রোক না করায় তা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। হলমার্ক গ্রæপের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকলেও কেন এসব স্থাবর সম্পদ ক্রোক করা হয়নিÑ জানতে চাইলে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, যখন মামলা হয়েছে (২০১২) তখন দুদক ক্রোক প্রক্রিয়া শুরু করেনি। সে কারণে স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও জব্দ করা হয়নি। তবে অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ব্যাংক হিসাবসহ এ সংক্রান্ত কাগজপত্র ও দলিলাদি জব্দ করা হয়েছে। স্থাবর সম্পদ জব্দ করা বা না করলেও বিচারে কোনো বিঘœ ঘটবে না বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন) আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, হলমার্কের ১১ মামলার বিচার শেষপর্যায়ে রয়েছে। তিনি আশা পোষণ করে বলেন, মামলাগুলোর বিচারকাজ শেষ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুদকের জব্দ তালিকায় স্থাবর সম্পদ না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১২ সালে আমি দুদকে ছিলাম না। হয়তো ক্রোক প্রক্রিয়া ছিল অন্যভাবে। তখন রিসিভার (ক্রোক কর্তৃপক্ষ) ছিল পুলিশ। তখনকার আইনে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া ছিল।
মামলার বিচারের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আমাদের দিক থেকে সাক্ষ্য আনতে কোনো গাফিলতি হয়নি। পেপারস অনেক। এগুলো এক্সিকিউট (নিষ্পত্তি) করতে অনেক সময় লেগেছে। সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি হুমায়ুন কবিরকে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তিনি বলেন, আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে পলাতক আসামি হিসেবে বিচার শুরু করেছেন। ফলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা তাকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করতে উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
ব্যাংক খাতে আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতা হলমার্ক গ্রæপ সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন এমডিসহ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ঋণের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এর মধ্যে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২ সালের প্রথম দিকে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠায়। তার আলোকে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধান করে জালিয়াতির নীলনকশার একটি চিত্র বের করে আনে। গ্রেপ্তার করা হয় হলমার্ক গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ, চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ও তানভীরের শ্যালক তুষার এবং সোনালী ব্যাংক শেরাটন শাখার তৎকালীন ম্যানেজারসহ ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে। তাদের বিরুদ্ধে প্রথম দফায় করা হয় ১১টি মামলা। প্রতিটি মামলায় তানভীর, জেসমিন, তুষার এবং সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি হুমায়ুন কবির ও সোনালী ব্যাংক শেরাটন শাখার তৎকালীন ম্যানেজার (ডিজিএম) আবদুল আজিজকে আসামি করা হয়। এই মামলাগুলোয় অপরাধীদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
এই ১১টি মামলা ছাড়াও হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় আরও ২৭টি মামলা করা হয় তখন। এই ২৭টি মামলার মধ্যে হলমার্ক গ্রæপের কর্মচারী ও তানভীর মাহমুদের কাছের লোক দিয়ে গঠন করা টিএম ব্রাদার্স, প্যারাগন নিট কম্পোজিট লিমিটেড, জিএন স্পোর্টস, নকশি নিট কম্পোজিটসহ পাঁচটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্টদের আসামি করা হয়। যার প্রতিটিতে তানভীর ও জেসমিন যৌথভাবে আসামি। তারা দুজনই এখন জেলে।
জালিয়াতির জন্য তানভীরের হলমার্ক গ্রæপ বেছে নেয় সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা। আর ওই শাখার তৎকালীন ম্যানেজার আজিজুর রহমান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে হলমার্ক গ্রæপ ও সোনালী ব্যাংকের এমডির মাঝে ভুয়া ঋণ জালিয়াতির সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতেন।
মামলার অনুসন্ধান, তদন্ত ও বিচার শুনানিতে সাক্ষীদের দেওয়া বক্তব্যের সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক নয়, হলমার্ক গ্রæপের লোকজনই ঋণের কাগজপত্র তৈরি করে দিত। সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার ম্যানেজারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা, প্রধান কার্যালয়ের এমডিসহ অন্যরা তাতে শুধু সই-স্বাক্ষর করতেন। হলমার্ক গ্রæপ শুধু নিজেই ঋণের নামে অর্থ আত্মসাৎ করেনি, একই সঙ্গে প্রভাব খাটিয়ে তাদের কর্মচারী দিয়ে গঠিত নামসর্বস্ব পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। হলমার্কের কর্মচারীদের দিয়ে গঠিত কাগুজে প্রতিষ্ঠান টিএম ব্রাদার্সসহ পাঁচটি কোম্পানিতে ঋণের টাকা ঢুকিয়ে মালামাল না এনেই ওভার এনভয়েসিং করে হলমার্কের ব্যাংক হিসাবে টাকা ঢোকানো হতো। এ ক্ষেত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্কের সঙ্গে ওই পাঁচটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের লেনদেন দেখানো হতো। হলমার্কের এমডি তানভীর ও তার শ্যালক তুষার প্রতিনিয়ত সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও শেরাটন শাখায় যাতায়াত করে একটি চক্র গড়ে তুলে বিপুল ওই অর্থ হাতিয়ে নেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে হলমার্কের এই ঋণকে ‘হাই রিস্ক’ বা ‘উচ্চঝুঁকি’ ঋণ উল্লেখ করে তা থামানোর জন্য সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দেয়।
মামলার সাক্ষ্যে আরও বেরিয়ে এসেছে, ব্যাংকের এমডি, ডিএমডি, শাখা ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘হাই রিস্ক’ বা ‘উচ্চঝুঁকি’ ঋণের ব্যাখ্যায় ‘নো রিস্ক’ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককেও প্রতারিত করেন। এখানেই শেষ নয়। হলমার্কের কাছে জালিয়াতির শিকার হয় জনতা ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি তফসিলি ব্যাংক।
হলমার্ক সোনালী ব্যাংকের গ্রাহক (ক্লায়েন্ট) হলেও জনতা ব্যাংকের গ্রাহক ছিল হলমার্কের কর্মচারীদের দিয়ে গঠিত ওই পাঁচটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর এলসির বিপরীতে জনতা ব্যাংক থেকে এলসির নিয়ম দেখিয়ে ৮০ পার্সেন্ট টাকা নিয়ে নেয়। এই টাকা সোনালী ব্যাংক থেকে জনতা ব্যাংকের পাওয়ার কথা থাকলেও গ্রাহক ভুয়া হওয়ায় হলমার্ক বা তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সোনালী ব্যাংক টাকা পায়নি। সে কারণে জনতা ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাংকে থাকা দায় শোধ করতে পারেনি।
দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা উদাহরণ টেনে বলেন, নন-ফান্ডেড ওই লেনদেনের ঘটনায় জনতা ব্যাংকের কাছে সোনালী ব্যাংকের দায় এখনো রয়ে গেছে। তিনি জানান, নন-ফান্ডেড এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা; যা পুরোটাই আত্মসাৎ করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ১৩৭টি শাখা এই টাকা পায়।
এদিকে অনুসন্ধান শেষে ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর হলমার্ক গ্রæপের চেয়ারম্যান, এমডি, ম্যানেজার, সোনালী ব্যাংকের এমডি, ডিএমডি, শাখা ম্যানেজারসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় ২০১৩ সালের জুনে চার্জশিট দেওয়া হয়। এ ছাড়া টিএম ব্রাদার্স, প্যারাগন নিট কম্পোজিটসহ তানভীরের কর্মচারীদের নামে প্যাডসর্বস্ব পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরও এক ডজন মামলা দেওয়া হয়। নন-ফান্ডেড ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দ্বিতীয় দফায় ১৫টি মামলা করে দুদক। এ ছাড়া অনুসন্ধানের পর তৃতীয় দফায় আরও ১২টি মামলা করা হয়। সবগুলো মামলার চার্জশিট ২০১৩ সালে দেওয়া হয়। মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তা ছিলেন দুদকের পরিচালক (গোয়েন্দা) মীর জয়নুল আবেদিন শিবলি। প্রায় আট বছর ধরে মামলাগুলোর বিচার চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবীরা বলেন, নানা কারণে এখনো মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন হয়নি। তবে সবগুলো মামলারই বিচারকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও সিনিয়র আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম এ বিষয়ে বলেন, মামলাগুলোর ৫০-৬০ জনের মতো সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। সব মামলার সাক্ষী প্রায় একই ব্যক্তি। এ ছাড়া সাক্ষীর তালিকায় দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন। কোনো কোনো মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত দেড় বছরের করোনার ধাক্কায় বিচারকাজ বিলম্বিত হয়। তিনি জানান, হলমার্কের কোনো মামলার এখনো রায় হয়নি।
এ বিষয়ে দুদকের আরেক আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর জানান, হলমার্কের মামলার বিচারকাজে নিয়োজিত দুজন বিচারক ইতোমধ্যে অবসরে চলে গেছেন। তিনি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বিচার কিছুটা প্রলম্বিত হলেও আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো মামলার রায় হয়ে যাবে।