শরীফুল ইসলাম
বাসাবাড়ির গ্রাহকদের জন্য তিতাস গ্যাসের প্রিপেইড মিটার দেওয়া শুরু হয় ছয় বছর আগে। প্রথম দিকে কিছুটা অনীহা থাকলেও সুবিধা পাওয়ায় এখন আগ্রহ বেড়েছে গ্রাহকদের দিক থেকে। মিটারের জন্য প্রতিদিন অনেক আবেদন জমা পড়ছে। কিন্তু এরপরও পরিকল্পনা মোতাবেক বাড়ছে না মিটার গ্রাহকের সংখ্যা। সমস্যাটা তাহলে কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রিপেইড মিটার বসানো হলে স্বচ্ছতা আসবে গ্যাস বিক্রির হিসাবে। এর ফলে গ্যাস চুরি ও অবৈধ সংযোগ দেওয়ার সুযোগ কমে যাবে। মূলত এ কারণেই প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজে ধীরগতি বলে মনে করেন তাঁরা।
মিটার স্থাপনে ধীরগতির সমালোচনা করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাসাবাড়িতে ৭৮ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের বিপরীতে ৯৭৫ টাকা বিল সংগ্রহ করে তিতাস। বাস্তবতা হচ্ছে, আদায় করা বিলের বিপরীতে ৪০ থেকে ৪৫ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। অর্থাৎ বাকি গ্যাসটা হিসাবের আওতায় থাকে না, যা হচ্ছে অবৈধ গ্যাস। আর এই অবৈধ গ্যাস বিক্রি করতে তিতাসের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী-ঠিকাদার স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে মিলে বছরে হাজার কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য করছেন।
রাজধানীর কল্যাণপুরের সানভিউ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা গফুর আহমেদের পরিবার পাঁচ সদস্যের। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বাসায় গ্যাসের প্রিপেইড মিটার বসায় তিতাস গ্যাস। এর পরই গফুর আহমেদের পরিবারে প্রতি মাসে ব্যবহার করা গ্যাসের খরচ নেমে আসে অর্ধেকেরও নিচে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চুলা হিসেবে আগে মাসিক বিল দিতাম ৯৭৫ টাকা। অথচ এখন কোনো মাসেই ৪০০ থেকে ৪৪০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে না।’
গফুর আহমেদের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে ছিলেন একই এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন ‘আশপাশের কিছু বাড়িতে প্রিপেইড মিটার বসানোর পর দেখতে পাচ্ছি, এত দিন বছরের পর বছর আমরা ব্যবহারের চেয়ে বেশি বিল দিয়ে এসেছি। মিটার বসানোর জন্য আমি অনেকবারই গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে, মিটার শেষ। পরে আবার এলে আমরা পাব।’
জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২০১৫ সালে এক আদেশে সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার নির্দেশ দেয় তিতাস গ্যাসসহ ছয়টি বিতরণ কোম্পানিকে। তিন বছরে অর্থাৎ ২০১৮ সালের অক্টোবরের মধ্যে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে দেশের ১২টি জেলায় প্রতিষ্ঠানটির আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা ২৮ লাখ ৫৫ হাজার ৩০২ জন। যাঁদের মধ্যে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রিপেইড মিটার পেয়েছেন মাত্র ২ লাখ ৪৫ হাজার গ্রাহক। অর্থাৎ মোট গ্রাহকের ৯ শতাংশ প্রিপেইড মিটারের আওতায় এসেছেন।
বর্তমানে প্রিপেইড মিটার স্থাপনে তিতাসের একটি প্রকল্প চলমান আছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া ‘ইনস্টলেশন অব প্রিপেইড গ্যাস মিটার’ প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমে তিন বছরে ২ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কথা থাকলেও নির্দিষ্ট মেয়াদে তা সম্ভব হয়নি। পরে মেয়াদের পাশাপাশি আরও ১ লাখ ২০ হাজার মিটার বসানোর কাজ যোগ হয়েছে। বর্তমান প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ৩ লাখ ২০ হাজার মিটার স্থাপনের কাজ শেষ করতে পারবেন বলে দাবি করেন প্রকল্পের পরিচালক ও তিতাস গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক ফয়জার রহমান।
এদিকে প্রিপেইড মিটারে আরও দুটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে তিতাস গ্যাস। এর একটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ৫ লাখ ৪৯ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপন, আরেকটি জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিক) অর্থায়নে ৭ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন। তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প দুটির প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এগুলোর কাজ শুরু হতে অন্তত এক বছর সময় লাগতে পারে।
বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মকবুল-ই-ইলাহি চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কম খরচে এবং দ্রুত সময়ে গ্রাহককে গ্যাসের প্রিপেইড মিটার দিতে হলে খোলাবাজারে মিটার বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। খোলাবাজারে মিটার বিক্রি হলে খরচও চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে।
এ জন্য গ্রাহকেরা নিজেরাই যাতে প্রিপেইড মিটার কিনে তিতাসের কর্মীদের সহযোগিতায় নিজেদের ভবনে লাগিয়ে নিতে পারেন, এ জন্য ২০১৯ সালে একটি নীতিমালা করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। কিন্তু নীতিমালাটি কাগজেই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বাজারে মিটার বিক্রি শুরু করতে পারেনি।
প্রিপেইড মিটার স্থাপনের গতি জোরদার করতে সমস্যা কোথায়–জানতে চাইলে তিতাসের এক মহাব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, শুরুতে গ্রাহকদের দিক থেকে কিছু অনাগ্রহ ছিল। প্রিপেইড মিটার নিয়ে কিছু ভোগান্তির খবর প্রকাশিত হওয়ায় অনেক গ্রাহক নিতে চাইতেন না। কিন্তু প্রথম দফায় ২ লাখ মিটার বসানোর পর এখন প্রতিদিনই গ্রাহকদের কাছ থেকে অসংখ্য আবেদন পাওয়া যাচ্ছে।
ওই মহাব্যস্থাপক বলেন, তিতাসের ভেতরে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, যাঁরা গ্যাসের অবৈধ সংযোগ-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। প্রিপেইড মিটার স্থাপন হলে গ্যাসের হিসাবে স্বচ্ছতা আসবে। এতে তাঁদের অবৈধ আয় কমে যাবে, এ কারণেই প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন–সকল পর্যায়ে বাধা দিচ্ছেন তাঁরা।
তবে সংকট সমাধানে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাস পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও জ্বালানি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আনিছুর রহমান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গ্যাসের অপচয় রোধ এবং বিতরণ কোম্পানিগুলোকে আর্থিকভাবে লাভবান করতে হলে প্রিপেইড মিটারের কোনো বিকল্প নেই। অবশ্যই সব গ্যাস ব্যবহারকারীকে মিটারের আওতায় আনা হবে। খোলাবাজারে মিটার বিক্রির জন্য কাজ চলছে। আশা করছি, শিগগিরই আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব।’