বিতর্কিতদের দখলে আইপি টিভি, কোণঠাসা মূলধারার সাংবাদিকতা

বিতর্কিতদের দখলে আইপি টিভি, কোণঠাসা মূলধারার সাংবাদিকতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘জনতার টিভি’ নামে একটি ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিভিশন (আইপি টিভি) খুলেছেন আতাউল্লাহ খান। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত ঘাতক ফারুক রহমানের ফ্রিডম পার্টি করতেন বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আছে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ। আতাউল্লাহর মতো বিতর্কিত আরও অনেকে খুলে বসেছেন আইপি টিভি। তাদের অনেকে চাঁদাবাজিতে অভিযুক্ত। আবার কেউ কেউ খুনের মামলার আসামি, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ একাধিকবার আটক হওয়া ব্যক্তি।
আইপি টিভিগুলোর মালিকদের অনেকে নিজেদের ক্ষমতাসীন দলের নেতা বলে পরিচয় দেন। অথচ দলে তাদের কোনো পদ-পদবি থাকার তথ্য পাওয়া যায় না। আইপি টিভির নামে ইউটিউবে চ্যানেল চালান। নিজেকে পরিচয় দেন পুরোদস্তুর টেলিভিশনের মালিক হিসেবে।
এ দেশে নামে-বেনামে কত আইপি টিভি চলছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই কারও কাছেই। একটি আইপি টিভিরও সরকারিঅনুমোদন নেই। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (টিভি-২) রুজিনা সুলতানা আইপি টিভি প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত একটি আইপি টিভিরও অনুমোদন তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়নি। অনেকে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার আলোকেই তাদের নিবন্ধনের কার্যক্রম চলছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইপি টিভির কথা জানা যাচ্ছে তার বড় অংশই চালাচ্ছে বিতর্কিত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। মুলধারার গণমাধ্যমে ঠাঁই না পেয়ে তারা নামে-বেনামে স্থান করে নিয়েছে আইপি টিভিতে। তারা আইপি টিভি ব্যবহার করে কী ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে সে ব্যাপারেও নজরদারি নেই। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে আইপি টিভির কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দেশের মূলধারার টিভিগুলো।
টিনুর ‘সিটিজি ক্রাইম’ : চার ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে নুর মোস্তফা টিনু দ্বিতীয়। টিনুর বড় ভাই মোহাম্মদ সেলিম জামায়াতে ইসলামীর রুকন পর্যায়ের একজন নেতা। টিনুর ছোট ভাই নুর মুহাম্মদ শিপু চট্টগ্রামের চকবাজার থানা ছাত্রদলের সভাপতি।
চট্টগ্রামের গোল পাহাড় মোড় থেকে ২০০৩ সালে একটি অত্যাধুনিক চাইনিজ একে-২২ রাইফেল, একটি ম্যাগাজিনসহ টিনুকে গ্রেফতার করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর টিনু নিজেকে যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। ২০১২ সালে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় টিনুর বিরুদ্ধে আবারও অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তাকে অস্ত্র-গুলিসহ আটক করে র‌্যাব।
টিনুর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম কলেজ ও মুহসীন কলেজে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। এ ছাড়া নগরীর পাঁচলাইশ, চান্দগাঁওসহ বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, জমি দখলের মামলা ও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে নগর পুলিশের তৈরি করা কিশোর গ্যাংয়ের ‘গডফাদার’ তালিকায় টিনুর নাম ছিল ওপরের দিকে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের একাধিক মামলায় অভিযুক্ত টিনুর রয়েছে ‘সিটিজি ক্রাইম’ নামে একটি আইপি টিভি।
হাছানের ‘চট্টলা ২৪’ : শিবির ক্যাডার মোহাম্মদ হাছানের নিয়ন্ত্রণে এখন চলছে ‘চট্টলা ২৪’ নামে একটি আইপি টিভি। নিজের ফেসবুক পেজ সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ছবি দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন। দেখলে মনে হবে হাছানের মতো আওয়ামী লীগ করা মানুষ দেশে কমই আছেন।
অথচ চট্টগ্রামের বড় অংশের মানুষই তাকে চেনেন অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি হিসেবে। চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী তার কলেজে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। আর এ কারণেই ২০০১ সালের ১৬ নভেম্বর তাকে নগরীর জামালখানের বাসায় কুপিয়ে খুন করে শিবির ক্যাডাররা। গোপাল কৃষ্ণ হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ২০০২ সালের ২০ আগস্ট নগর গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারী উত্তর মাদ্রাসা থেকে গ্রেফতার করে হাছানকে। তবে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে তিনি ওই মামলায় ছাড়া পান।
সাবেক শিবির ‘নেতা’র জনতার টিভি : মুহাম্মদ আতাউল্লাহ খানের ভিজিটিং কার্ডের পরিচয় অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশ গণআজাদী লীগের মহাসচিব। দলটি ১৪ দলীয় জোটের শরিক। জনতার টিভি নামে একটি আইপি টিভির মালিক এই আতাউল্লাহ খান। আইপি টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তার বিরুদ্ধে ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি ‘কর্নেল’ ফারুকের দল ফ্রিডম পার্টি করতেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব কারণে ২০২০ সালে গণআজাদী লীগের মহাসচিব পদ থেকে আতাউল্লাহ খানকে বহিষ্কারও করা হয়।
আতাউল্লাহ খান সম্পর্কে জানতে চাইলে মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ বলেন, ‘তাদের পরিবারটি আওয়ামী ঘরোনার নয়। জামায়াত-শিবিরের সাংস্কৃতিক সংগঠন পাঞ্জেরী শিল্পগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় পরিচালক ছিলেন আতাউল্লাহ খান। তাদের পরিবারটি বিতর্কিত। বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর ডালিমের সঙ্গে তাদের পরিবারের সখ্য ছিল।’
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আতাউল্লাহ খান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি, এটাই আমার অপরাধ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই শিবির হবে এমন তো কথা নেই।
আরিয়ান লেনিনের ‘সি ভিশন’ : আরেক আইপি টিভির মালিক চট্টগ্রামের আরিয়ান লেনিন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হুমকি দিয়ে টাকা নিয়ে থাকেন। গত বছরের ২০ এপ্রিল শেঠ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ সোলায়মান আলম শেঠ চট্টগ্রামের চকবাজার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সি ভিশনের মালিক আরিয়ান লেনিনের বিরুদ্ধে। এতে অনৈতিক সুবিধা আদায় ও কাল্পনিক সংবাদ প্রকাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ সোলায়মান আলম শেঠ বলেন, ‘গত বছর এরকম অভিযোগে একটা জিডি করেছিলাম।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।
গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর রাতে সাভারের হেমায়েতপুরের মোল্লা মার্কেটের তৃতীয় তলায় নিউজ টিভি বাংলা নামে একটি আইপি টিভির অফিসে অভিযান চালায় র‌্যাব-৪। অফিসটিতে তল্লাশি চালিয়ে প্রতারণার ৯০ হাজার টাকা, ইয়াবা, বিদেশি মদও উদ্ধার হয়।
এভাবেই অনুমোদনহীন আইপি টিভি সারা দেশে ছেয়ে গেছে। মূলধারার সাংবাদিকতা এসব আইপি টিভির কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে অনেক ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক নেতা ও ডিবিসি নিউজ চ্যানেলের চেয়ারম্যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘দেশে অনলাইনের নামে, আইপি টিভির নামে যা হচ্ছে, বিশেষ করে জয়যাত্রা ধরা পড়ার পর, সেটা সাংবাদিকতার মানদণ্ডে ভালো কিছু হচ্ছে না।
তথ্য প্রুযুক্তি