অথৈ সমুদ্র, যে দিকে চোখ যাচ্ছিল শুধু পানি আর পানি। সমুদ্রের ঢেউয়ে যে কোনও মুহূর্তে মাঝারি আকারের পাল তোলা নৌকার ভাঙা অংশটি ডুবে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে দুই সন্তানকে আঁকড়ে ধরে ওই ভাঙা অংশেই বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন এক মা।
টানা চার দিন মাঝ সমুদ্রে এভাবেই লড়াই চালিয়ে যান তিনি। সাথে থাকা দুই সন্তানের জীবন বাঁচাতে নিজের স্তন্যপান করিয়েছেন। আবার খাবার পানীয় না থাকায় নিজেই করেছেন নিজের মূত্রপান। অবশেষে তার সন্তানদের জীবন রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু সন্তানদের জীবন বাঁচিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন ওই মা।
গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল ও নিউইয়র্ক পোস্ট। সন্তানের জীবন বাঁচিয়ে নিজেই না ফেরার দেশে চলে যাওয়া ওই মায়ের নাম মেরিলি চ্যাকন। তিনি ভেনেজুয়েলার নাগরিক।
ডেইলি মেইল জানিয়েছে, জোস ডেভিড ও মারিয়া বেতরিজ ক্যামব্লর চ্যাকনসহ পরিবারের সদস্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে মাঝারি আকারের পাল তোলা একটি নৌকায় আটলান্টিক মহাসাগরের একটি দ্বীপে ভ্রমণে যাচ্ছিলেন ৪০ বছর বয়সী মেরিলি চ্যাকন। মাঝ সমুদ্রে প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে তাদেরকে বহনকারী ওই নৌকাটি নষ্ট হয়ে যায়।
ধ্বংস হয়ে যাওয়া ওই নৌকাটিতে মেরিলি চ্যাকন তার ছয় বছর বয়সী ও দুই বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে ভাসতে থাকেন। এসময় তাদের অবস্থান সমুদ্রের ৭০ মাইল ভেতরে ছিল বলেও জানিয়েছে ডেইলি মেইল।
সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, অসহায় ওই পরিস্থিতিতে ক্রমেই শরীর অবসন্ন হয়ে আসছিল দুই সন্তান ও মায়ের। এর মধ্যে সূর্যের তাপে শরীরে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা সৃষ্টিরও ভয় পাচ্ছিলেন মা মেরিলি। সঙ্গে কোনো খাবার পানীয় ছিল না, খাবার ছিল না। ছেলেমেয়েকে বাঁচাবেন কী করে!
উপায় না দেখে নিজের প্রস্রাব পান করেছিলেন যেন শরীর ডিহাইড্রেট হয়ে না যায়। আর ছেলেমেয়েকে ডিাইড্রেশন থেকে বাঁচাতে নিজের স্তন্যপান করিয়েছেন। তিন দিন গভীর সমুদ্রে এভাবেই কাটিয়েছেন। কিন্তু চতুর্থ দিন আর পারেননি।
উদ্ধারকারীরা আসার আগে পানি শূন্যতার কারণে মারা যান মেরিলি চ্যাকন। কিন্তু সন্তানদের বাঁচিয়ে গেছেন তিনি। মায়ের নিথর দেহ আঁকড়ে দুই শিশুকে ভাসতে দেখেছিলেন উদ্ধারকারীরা। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর ভেনেজুয়েলা থেকে ক্যারিবীয় দ্বীপ লা তোর্তুগাতে বেড়াতে গিয়েছিলেন মেরিলি। থর দ্য হিগুরেতে নামে একটি ইয়াট (মাঝারি আকারের পাল তোলা নৌকা) ভাড়া করেন তারা। জনমানবহীন দ্বীপে একটি রোমাঞ্চকর ভ্রমণ নিয়ে উৎসাহ আর উদ্দীপনা ছিল মেরিলিদের মধ্যে।
সন্তানসহ মেরিলিরা সংখ্যায় ৯ জন ছিলেন। গত ৫ সেপ্টেম্বরই ফিরে আসার কথা ছিল তাদের। কিন্তু ৫ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা বেজে গেলেও ফেরেননি মেরিলিরা। তখন সন্দেহ হওয়ায় ভেনেজুয়েলার ন্যাশনাল মেরিটাইম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই সংস্থা। তাদের জানানো হয় গন্তব্যস্থলে ইয়াট পৌঁছায়নি, যেখান থেকে রওনা হয়েছিলেন; সেখানেও ফিরে আসেনি।
এই পরিস্থিতিতে গত ৬ সেপ্টেম্বর মেরিলিদের খোঁজ শুরু করে ভেনেজুয়েলার মেরিটাইম কর্তৃপক্ষ। অনুসন্ধানকারী দলটি লা অর্চিলা দ্বীপের কাছে ইয়াটের ভাঙা অংশ দেখতে পায়। এরপর ৭ সেপ্টেম্বর সকালে ওই দ্বীপ থেকে কিছুটা দূরে তারা ইয়াটের একটি ভাঙা অংশ সমুদ্রে ভাসতে দেখেন। তাতে দুই সন্তান-সহ মেরিলিকে দেখতে পান তারা। মেরিলিদের উদ্ধার করা গেলেও বাকি সদস্যরা এখনও নিখোঁজ।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পানি শূন্যতার কারণে ওই দুই সন্তানের মা মেরিলি চ্যাকন মারা গেছেন।