প্রতারণায় এবার সিটি বাজার

প্রতারণায় এবার সিটি বাজার

এসএম মিন্টু

প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ই-কমার্স ও এমএলএম প্রতিষ্ঠানগুলো। এভাবে অর্থ আত্মসাতের অপরাধে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনকে গ্রেফতারের পরও থেমে নেই এ ধরনের প্রতারণা।

প্রতারণার অভিযোগে ই-কমার্স ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, রিং আইডি, ধামাকা, কিউকম ও এমএলএম এসপিসি ওয়ার্ল্ডের পর এবার সিটি বাজার নামে আরও একটি এমএলএম প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ফাঁদ পাতার তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন বোরহান উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। সূত্র জানায়, এই চক্রের আরও কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যারা আন্তর্জাতিক এমএলএমের নামে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমএলএম কোম্পানি সিটি বাজার চলতি বছরের জুনে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। আকর্ষণীয় অফার পেয়ে প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহক এই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়। সম্প্রতি সিআইডির হাতে গ্রেফতার হওয়া আল আমিন ও তার স্ত্রী পরিচালিত এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের মতোই সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সিটি বাজার।

কোম্পানিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বোরহান উদ্দিন আগে থেকেই এমএলএম ব্যবসায়ের নামে প্রতারণা করে আসছিলেন। তারকাভিত্তিতে ২০ লাখ টাকা গাড়ি উপহার ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, সিটি বাজার প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই আন্তর্জাতিক এমএলএম প্রতিষ্ঠান জুনেস গ্লোবালের সঙ্গে যুক্ত হন বোরহান উদ্দিন। তবে জুনেস গ্লোবাল বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অবৈধ।

সূত্র আরও জানায়, রাজধানীর বাড্ডার নতুন বাজার এলাকার কোকাকোলা রোডের একটি ভবনের তৃতীয় তলায় টিভি, ফ্রিজ ও বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এমএলএম ব্যবসা শুরু করেন বোরহান উদ্দিন। সেখান থেকে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে অনলাইনে অ্যাপসের মাধ্যমে এমএলএম প্রতিষ্ঠান সিটি বাজার চালু করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি চালুর পর প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহক তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিভিন্ন আকর্ষণীয় অফারের মাধ্যমে জেলায় জেলায় তাদের এজেন্ট কাজ করছে।

ইতোমধ্যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, রিং আইডি, ধামাকা ও এমএলএম প্রতিষ্ঠানসহ এসপিসির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও পরিচালকরা গ্রেফতারের পর সিটি বাজারে ধস নামা শুরু হয়েছে। এতে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতেরও অভিযোগ উঠেছে।

যেভাবে গ্রাহকদের আকর্ষণীয় অফার দেওয়া হয় : অফারে লিডারদের জন্য অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এর মধ্যে অ্যাকাউন্ট-টু-অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার করা হয় ১০০ টাকা। অ্যাকাউন্টে মাত্র ৫০০ টাকা হলেই নিজের বিকাশ, রকেট, নগদের মাধ্যমে নিজেই টাকা ওঠাতে পারবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।

জয়েনিং ও লভ্যাশেংর পদ্ধতি : ১ হাজার ৫০০ পয়েন্টের পণ্য ক্রয় করলেই একটি বিজনেস সেন্টার পাবেন গ্রাহকরা। প্রতি পয়েন্টে রয়েছে ১ টাকা। এখানে অর্থ উপার্জনের জন্য আট ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছে প্রষ্ঠিানটি। বলা হয়েছে, অ্যাপসের মাধ্যমে প্রতিদিন মাত্র ২টি অ্যাড ভিজিট করলেই গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিদিন ১০ টাকা করে যোগ হতে থাকবে। তবে এই সুবিধা থাকবে এক বছরের জন্য। এরপর আইডি নবায়ন করতে হবে।

সিটি ওয়ার্ল্ডের একজন গ্রাহক জানান, গ্রাহকের একটি প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এক বছরের জন্য প্রতিদিন পাওয়া যাবে ১০ টাকা। ১০০টি প্যাকেজের জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে যিনি প্যাকেজ কিনবেন তিনি প্রতিদিন পাবেন ১০০ টাকা। আর এক হাজার প্যাকেজের মূল্য ১৫ লাখ টাকা। তিনি প্রতিদিন পাবেন ১০ হাজার টাকা।

যিনি গ্রাহক সংগ্রহ করে দেবেন তিনি পাবেন ২০ শতাংশ। অর্থাৎ ৩০০ টাকা। এ ছাড়াও মাত্র একজন গ্রাহক দেওয়া হলেই প্রতিদিন রেফারাল রয়েলিটি হিসেবে ৫০ পয়সা করে প্রতিদিন যোগ হতে থাকবে।

প্রতি প্যাকেজে জেনারেশন ইনকাম : গ্রাহক সূত্র জানায়, প্রথম জেনারেশন পাবে ৫০ টাকা। দ্বিতীয় জেনারেশন পাবে ২০ টাকা। তৃতীয় জেনারেশন পাবে ১০ টাকা। এমনি করে দশ জেনারেশন পর্যন্ত ১০ টাকা করে পাবে। প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে এখানে বাইনারি ইনকাম পদ্ধতি চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২ হাজার প্যাকেজের জন্য প্রতিদিন গ্রাহকের আয় দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

পদমর্যাদা : মোট দশটি পদবির জন্য ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকার পুরস্কারের ব্যবস্থাও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৫ হাজার, ১০ হাজার ও ৩০ হাজার টাকা। এভাবে পদমর্যাদা ১০ জন গ্রাহকের জন্য ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়াও গ্লোবাল সেলের প্রতি প্যাকেজ থেকে ১২৫ টাকা জমা হবে পুলে। র‌্যাঙ্কের ওপর ভিত্তি করে মাসিক মাসিক ইনকামেরও ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম অনুযায়ী প্রথমজন ২৫ শতাংশ থেকে সপ্তম র‌্যাঙ্ক পর্যন্ত ৫ শতাংশ হারে অর্থ দেবে সিটি বাজার। লিডারশিপ ব্রোঞ্জ স্টারে রয়েছে সিলভার ৫ শতাংশ ও ক্রাউন তারকা ৫ শতাংশ।

ফাউন্ডার : প্রথম ১০০ জন তিন তারকা হবেন কোম্পানির ফাউন্ডার। তারা প্রত্যেকে প্রতি মাসে মোট প্যাকেজ থেকে ১ টাকা করে পেতে থাকবেন। তবে ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যারা নতুন র‌্যাঙ্ক পাবেন তারা অতিরিক্ত ইনসেনটিভ হিসেবে পাবেন এক তারকা। এক তারকা যিনি পাবেন তিনি ঢাকা-টু-কক্সবাজার, ২ তারকাকে কক্সবাজার ট্যুর এবং একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন সেট, ৩ তারকাকে ভারত যাওয়া-আসার খরচ, একটি ল্যাপটপ এবং ফাউন্ডার সদস্য করা হবে। ৪ তারকা পাবেন ঢাকা-থাইল্যান্ড-ঢাকা ট্যুর ও একটি মোটরসাইকেল আর ৫ তারকা হলে বিদেশ সফরসহ ২০ লাখ টাকা মূল্যের একটি প্রাইভেট কার পাবেন।

এমন লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষের সঙ্গে গত জুন থেকে প্রতারণা করে আসছে সিটি বাজার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় কোটি কোটি টাকা নিয়েছে। এরই মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি নজরদারি বৃদ্ধি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের একের পর এক অভিযানের কারণে প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা আতঙ্কে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি যেকোনো সময় তাদের ব্যবসা গুটিয়ে পালিয়ে যেতে পারে বলেও ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রতিষ্ঠানে যারা অর্থ দিয়ে প্যাকেজ কিনেছেন তার ৯০ শতাংশ গ্রাহকই সিটি বাজার থেকে অর্থ আদায়ের শঙ্কায় ভুগছেন।

অর্থ বাণিজ্য তথ্য প্রুযুক্তি