অপরাধ জগৎ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৩ সহস্রাধিক বিদেশি

অপরাধ জগৎ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৩ সহস্রাধিক বিদেশি

এসএম মিন্টু বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও প্রতিবছর হাজার হাজার বিদেশি পর্যটক আসে। অনেকেই ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অবৈধভাবে থেকে যায় এখানে। এদের অনেকেই দেশীয় প্রতারক চক্রের সঙ্গে মিলে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে। তারাই এখন দেশের অপরাধ জগৎ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, অবৈধভাবে বসবাস করা অন্তত তিন সহস্রাধিক বিদেশি নাগরিক নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। ওই চক্রের বেশিরভাগই নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও চায়নাসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক। এরই মধ্যে নাইজেরিয়ান একটি চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৫১ ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনারও তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। এই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি বিদেশি চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র, ইয়াবা, হেরোইন, জাল ডলার, জাল টাকা এমনকি ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে আসা পার্সেলের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্রটি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশীয় চক্র। শতাধিক নারী এই চক্রের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকের সংসার ভেঙেছে। চক্রটি রাজধানীর গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডি ও ভাটারার একটি বিশেষ জায়গায় অবস্থান করছে।

পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত শুধু রাজধানীতে তিন হাজারের বেশি বিদেশি বসবাস করছে। তাদের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে প্রতিবেশীরা। প্রতিদিনই তারা কোনো না কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন, এডিজি) কর্নেল কেএম আজাদ সময়ের আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি চক্র সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। র‌্যাব সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতারও করেছে। তিনি আরও জানান, এই চক্রটি এখনও সক্রিয়। আমরা তাদের গ্রেফতারে কাজ করছি।

হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর এপিবিএন সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত অবৈধভাবে থাকা ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত অনেক বিদেশি চক্রকে গ্রেফতার করেছে এপিবিএন। গ্রেফতারের পর তাদের সিআইডির কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওই সূত্র জানায়, এই মামলাগুলো মূলত বেশি দেখে সিআইডি। পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত বিদেশি চক্রের অনেককে গ্রেফতার করা হলেও গ্রেফতারের কোনো তালিকা তাদের কাছে নেই।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশীয় এই চক্রটি কখনও কাস্টমস কর্মকর্তা আবার কখনও শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয়ে প্রতারণা করছে। সাধারণ ডিম ব্যবসায়ী ও রাজমিস্ত্রির নামে অ্যাকাউন্ট খুলে ওই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। এখনও প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানায় গোয়েন্দারা।

র‌্যাব সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২০৯ জন অবৈধ বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে চারটি বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিন ৮টি, গুলি ২৭ রাউন্ড, এলজি একটি, চাকু ১টি, হেরোইন ৪ কেজি ১০০ গ্রাম, ইয়াবা, ভিওআইপি সরঞ্জামাদিসহ বিপুল পরিমাণ জিনিস জব্দ করা হয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গুলশান বিভাগের একটি দল প্রতারণাসহ বিদেশ চক্রের সঙ্গে মিলে নানা অপকর্মে জড়িত মর্জিনা ও শহিদুলসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে। তাদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, প্রায় এক বছর আগে মর্জিনার সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে শহিদুল। ওই সময় তাকে প্রস্তাব দেয় এই চক্রে জড়িত হওয়ার জন্য। শহিদুল জানায়, এই পথে অল্পদিনে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। রাজি হয় মর্জিনা। তারপর প্রশিক্ষণ দেয় শহিদুল নিজেই। প্রথম কাজ দেওয়া হয় তাকে ব্যাংকে কিছু অ্যাকাউন্ট করাতে হবে। অ্যাকাউন্ট যাদের নামে হবে তাদের প্রত্যেককে দেড় হাজার করে টাকা দেওয়া হবে। অ্যাকাউন্টের (স্বাক্ষরসহ) চেকবই, পাসওয়ার্ডসহ এটিএম কার্ড সব থাকবে শহিদুলের কাছে। প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই সফল মর্জিনা। এই মর্জিনা-শহিদুল চক্রটি নাইরেজিয়ান একটি অপরাধী চক্রের সঙ্গে মিলেমিশে প্রতারণাসহ নানা অপকর্ম চালাচ্ছিল।

নাইজেরিয়ান চক্রের হাতে ৫১ ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট : তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, নাইজেরিয়ান চক্রটি বাংলাদেশের অন্তত ৫১ ব্যক্তির নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণার টাকা লেনদেন করে আসছিল। চক্রটির মূল হোতা সাইফুর রহমান মিঠু। গত ২৭ সেপ্টেম্বর সাইফুর এবং তার দুই সহযোগীকে দুদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা নাইজেরিয়ানদের নিয়ে চক্র গড়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। মিঠুর ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১৬৪১৫১০৪৬১২৮৬ নম্বর অ্যাকাউন্টে কোটি টাকার বেশি লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি। এই ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ ৫১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের এটিএম কার্ড এবং ১৮টি চেকবইয়ের মাধ্যমে পাওয়া অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়ে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে সিআইডি চিঠি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসাইন।

তিনি জানান, মিঠুর দুই সহযোগী খালেদ হাসান ও তার স্ত্রী জাহেদা খানমকে গত ৬ সেপ্টেম্বর মিরপুরের শাহআলী থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বাসা থেকে ৫১টি ব্যাংকের এটিএম কার্ড এবং ১৮টি চেকবই জব্দ করা হয়। এসবের বিপরীতে থাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন ব্যবস্থাপনা করত খালেদ এবং জাহেদা। পার্সেল পাওয়ার নামে ভুক্তভোগীদের যেসব টাকা ওইসব অ্যাকাউন্টে জমা হতো, তা উত্তোলন করে মিঠুর হাতে দিত ওই দম্পতি। তবে মিঠু অন্য মামলায় দুই মাস আগেই গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে ছিল। মিঠুর বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার মধুখালীতে। সেসহ অন্যান্য সব চক্রের সদস্য বিভিন্ন ব্যক্তির নামে অসংখ্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। প্রতারণার মাধ্যমে আদায় করা এসব টাকা মিঠুকে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে খালেদা-জাহেদা দম্পতি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাইজেরিয়ানদের নিয়ে গড়া এ চক্র বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে ১৬টি অ্যাকাউন্ট খুলেছে। ব্র্যাক ব্যাংকে খুলেছে ছয়টি অ্যাকাউন্ট।

অ্যাপসে সুদের ব্যবসা : গত ৭ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা ও ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকা থেকে দুই চীনা নাগরিকসহ সাতজনকে গ্রেফতার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিট। তারা অ্যাপস ব্যবহার করে ডিজিটাল মাইক্রো ফাইন্যান্সের নামে অবৈধ সুদের ব্যবসা পরিচালনা ও গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করত। গ্রেফতার চীনা নাগরিক হি মিংশি ও ইয়াং সিকি এবং বাংলাদেশি নাগরিক মজুমদার ফজলে গোফরান, আহসান কামাল, হিমেল-অর-রশিদ, নাজমুস সাকিব ও জেরিন তাসনিম বিনতে ইসলাম। তাদের দুদিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

অপরাধ