আওয়ামী লীগে হাইব্রিড সঙ্কট

আওয়ামী লীগে হাইব্রিড সঙ্কট

দলের অভ্যন্তরে অস্বস্তি বাড়ছে আওয়ামী লীগের। গাজীপুর সিটির মেয়র জাহাঙ্গীরের ভাইরাল অডিও, রংপুরের পীরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় আটক ‘ছাত্রলীগ নেতা’ সৈকত মণ্ডল, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্নমতের লোকদের হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দেওয়ার সমালোচনায় ক্ষমতাসীন দলে এ অস্বস্তি বাড়ছে।
অস্বস্তি আরও বেড়েছে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিহতে দল ও প্রশাসনের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এসব বিষয় নিয়ে তিন বাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ প্রধানসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় সরকারবিরোধী শক্তি ইন্ধন দিচ্ছে, সরকার পক্ষ থেকে যখন এমন বক্তব্য দেওয়া হচ্ছিল তখনই আলোচনায় আসে পীরগঞ্জের ঘটনায় কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতার নাম। পরে সেই সৈকতকে বহিষ্কার করা হয়। এমনকি কলেজের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিও বিলুপ্ত করে রংপুর মহানগর ছাত্রলীগ।
এসব বিষয়গুলো আওয়ামী লীগের সঙ্কট কি না- এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সময়ের আলোকে বলেন, সংগ্রাম, সাফল্যে ও দেশের যেকোনো সঙ্কটে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। যখন গণতন্ত্র সঙ্কটের মুখে পড়ে তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নেতৃত্ব দেয়। জাতির পিতার নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীন করেছে। যেকোনো পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য কাজ করে যায়।
ছাত্রলীগ দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, সৈকত মণ্ডল নামে এক ছেলে ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির নেতা ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কীভাবে অনুপ্রবেশ করল সে জন্য পুরো কমিটি বাতিল করা হয়েছে। কোনো সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, প্রগতিশীলতাবিবর্জিত মানুষের আওয়ামী লীগ বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন করার সুযোগ নেই।
কীভাবে এমন অনুপ্রবেশ ঘটে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো গুপ্ত পার্টি নয়। যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী ব্যতীত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ আছে। অনেকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য ঢুকে পড়ে। ধরা পড়লেই আমরা কিন্তু বের করে দেই। যেই অপরাধ করুক তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তবে ঘটনার সাত দিন পর গত রাতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য সময়ের আলোকে বলেন, এ সৈকত মণ্ডল ওই সৈকত মণ্ডল নন। তিনি কারমাইকেল কলেজের ছাত্র নন, ছাত্রলীগেরও কেউ নন।
গাজীপুরের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করে নিজে যেমন সঙ্কটে পড়েছেন, দলকেও সঙ্কটে ফেলেছেন। তার বক্তব্য দলের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছে। ফলে তাকে দলে রাখলে তার বক্তব্যে সায় দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে তার দুঃখ প্রকাশ করে দেওয়া নোটিসের জবাবে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সন্তুষ্ট নয় বলে জানিয়েছে। জাহাঙ্গীরের বক্তব্যকে ঘিরে গাজীপুর আওয়ামী লীগও উত্তপ্ত। এ উত্তাপ ছড়িয়েছে কেন্দ্র পর্যন্ত। দলের সাধারণ সম্পাদককে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে যে বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমাদের সবাইকে আহত করেছে।
জাহাঙ্গীরের অস্বাভাবিক উত্থান : গাজীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ও সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, জাহাঙ্গীরের রাজনীতিতে উত্থান এলাম, দেখলাম, জয় করলামের মতো।
ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। এরপর গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। তার কারণেই সেবার দলের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান পরাজিত হন বলে আওয়ামী লীগের অনেকে দাবি করেন। তারপরও আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং অঢেল অর্থ-বিত্তের কারণে জাহাঙ্গীরের নাটকীয় উত্থান ঘটে। তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান। সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা আজমত উল্লাহ খানকে বাদ দিয়ে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর গাজীপুরের কর্তৃত্ব নেন জাহাঙ্গীর। আর এখানেই গাজীপুরের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাদের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার ১৪ মিনিটের ভাইরাল অডিও আওয়ামী লীগে তোলপাড় তৈরি করে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, একজন রাজনৈতিক নেতাকে যেভাবে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে হয়, সেটি ঘটেনি জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রে। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো রাজনীতির মূল মঞ্চে চলে আসেন জাহাঙ্গীর। আলোর ঝলকানির এ উত্থান হয়তো ধূমকেতুর মতো বিদায় নেবে। রেখে যাবে অনেক প্রশ্ন। কাদের হাত ধরে এমন অস্বাভাবিক উত্থান হলো এ জাহাঙ্গীরের।
ইউপি নির্বাচনে অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ : ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনের অভিযোগ করেছেন কুমিল্লা হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে- এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কুমিল্লা-২ আসনের সংসদ সদস্য সেলিমা আহমেদ মেরীর বিপুল আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি বর্তমানে ব্যাপকভাবে আলোচিত সমালোচিত হচ্ছে।
উপজেলা শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ স্বাক্ষরিত ওই অভিযোগে বলা হয়, আসন্ন তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না। এলাকার একটি চক্র বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে দলীয় গঠনতন্ত্র অমান্য করে বিতর্কিত ও হাইব্রিডদের মনোনয়ন দিয়ে কেন্দ্রে তালিকা পাঠাচ্ছে। এতে দলের বিশ্বস্ত ও ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত হয়ে ক্ষোভে ফুসছেন। সৃষ্টি হচ্ছে দলীয় কোনো্দল। এই অবস্থা চলতে থাকলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা ও আস্থাহীনতা দেখা দিতে পারে। তাই বিষয়টি জরুরিভিত্তিতে আমলে নিয়ে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রার্থী বাছাইয়ে সভাপতির হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
শুধু কুমিল্লার হোমন নয়, ইউপি নির্বাচনে সারা দেশ থেকে প্রচুর অভিযোগ জমা পড়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দফতরে।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার একটি ইউনিয়নে মামলার পলাতক আসামিকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কেন্দ্রে অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের ১নং তেলিগাতী ইউনিয়নে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন নজরুল ইসলাম খান। মনোনয়ন না পেয়ে তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবর ফেসবুকে খোলা চিঠি লেখেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলাকারী এ নেতা উল্লেখ করেন- তিনি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান হলেও তার পরিবর্তে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী পরিবারের লোক মনোনয়ন পেয়েছে। এটি মানতে না পেরে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর দল থেকে বহিষ্কার ও হামলা-মামলার ঘটনা ঘটে।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার রশিদনগর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগরের এক সময়ের শিবিরকর্মী মোয়াজ্জেম মোর্শেদ। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ২০১৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীকে অপহরণ ও হামলার মূল হোতা মোয়াজ্জেম মোর্শেদ। তিনি মনোনয়ন পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীরা। যদিও মোর্শেদ নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবেই দাবি করেছেন।

ফেনীর পরশুরাম উপজেলার ১নং মির্জাগঞ্জ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া নুরুজ্জামান ভুট্টোকে ‘জামায়ত শিবিরের পৃষ্ঠপোষক, দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ, কালোবাজারি’ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির বহরমপুর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন রেজাউল করিম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি ২০১৩ সালে বহরমপুর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগে যুক্ত হন।
বান্দরবানের লামার রূপসী ইউনিয়নে মনোনয়ন পাওয়া ছাচিং প্রু মার্মার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক বানানো, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম ও ধর্ষণ মামলাসহ নানা অভিযোগ আছে। তার মনোনয়নে ক্ষোভ প্রকাশ করে কেন্দ্রে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাচিং প্রু মার্মা।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানা বিএনপির সহসভাপতি ও কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই বলেন, তিনি কীভাবে মনোনয়ন পেলেন, কারাই বা প্রস্তাব করল আমি কিছু জানি না। সেন্টু বিএনপি করেন কি না জানতে চাইলে আবদুল হাই বলেন, সেন্টু শুধু বিএনপি না, সে ভূমিদস্যু ও কিলার।

সর্বশেষ মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়ার্নিং দিয়ে বলেছেন, তৃণমূল থেকে বিতর্কিত নাম পাঠালে, প্রমাণিত হলে প্রয়োজনে ওই কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি করা হবে।

Others জাতীয়