খরচ বাড়ছে ডিজেলচালিত সাড়ে ১২ লাখ সেচ পাম্পে বাড়তি উৎপাদন খরচ নিয়ে উদ্বেগে সোয়া কোটি কৃষক
সাইদ শাহীন দেশের মোট চালের অর্ধেকের বেশি উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে। বোরো আবাদ অতিমাত্রায় সেচনির্ভর। ফলে এ ধান চাষে মোট খরচের প্রায় অর্ধেকই ব্যয় হয় সেচকাজে। বোরো মৌসুমে সেচকাজে নিয়োজিত থাকে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ ডিজেলচালিত পাম্প। সম্প্রতি ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষিপণ্য পরিবহন ও সেচ খরচও আনুপাতিক হারে বাড়বে। সেচ খরচ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে চুক্তির সময় পাম্পমালিক ও কৃষকদের মধ্যে বিরোধ বাড়বে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশের ১ কোটি ২৩ লাখ কৃষক ডিজেলচালিত যন্ত্রের মাধ্যমে সেচকাজ পরিচালনা করেন। বাড়তি উৎপাদন খরচের কারণে এ বিপুল পরিমাণ কৃষক উদ্বেগের মধ্যে পড়বেন। বিএডিসি বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের প্রায় ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে। এখনো জমিতে সেচ দেয়ার ক্ষেত্রে অগভীর নলকূপের প্রাধান্য রয়েছে। ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র দিয়েই জমিতে পানি সরবরাহ করা হয়। মোট সেচকৃত এলাকার ৪৭ শতাংশ জমিতে সেচ প্রদানে ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যুচ্চালিত যন্ত্র। বাকি ৫৩ শতাংশ জমিতে পানি দিতে ব্যবহার করা হয় ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র। অর্থাৎ ডিজেলের বাড়তি দামের বোঝা গিয়ে পড়বে অর্ধেকেরও বেশি জমিতে চাষ করা কৃষকদের ওপর। বাংলাদেশে কৃষিজমি আবাদে মূলত কৃষি উপকরণ হিসেবে বীজ, সেচ, প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব উপকরণ ব্যবহারের কারণে কৃষকের খরচ হয় গড়ে ১৪ হাজার ৯০১ টাকা। যার প্রায় ৪৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ বা ৬ হাজার ৪৭৩ টাকা ব্যয় হয় সেচকাজে। আবার গোটা কৃষি খাতে জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সেচকাজে। দেশে গত অর্থবছরে প্রায় ১৬ লাখ সেচযন্ত্র পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে ডিজেলে চলেছে ১২ লাখ ৪৪ হাজার। বাকিগুলো বিদ্যুতে পরিচালিত হয়েছে। এছাড়া কৃষিপণ্য পরিবহনে ডিজেলের ব্যবহার রয়েছে। এতে চলতি রবি মৌসুমের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে। সম্প্রতি ডিজেলের দাম ৬৫ থেকে প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে। এ মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে কৃষি খাতে। বিশেষ করে আসন্ন বোরো মৌসুমে প্রথম ধাক্কা খাবেন কৃষক। বাড়তি খরচ করে উৎপাদনের পর ন্যায্যমূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রি করা যাবে কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে কৃষকের। এরই মধ্যে আমন ধানে বাড়তি ব্যয় গুনতে হচ্ছে তাদের। জমি চাষসহ নানা কাজে খরচও বাড়তে শুরু করেছে। এ বিষয়ে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার পূর্ব মালশাদহ গ্রামের কৃষক আবুল হাসেম বণিক বার্তাকে জানান, নয় বিঘা জমিতে তিনি আমন ধান আবাদ করেছেন। চাষাবাদ এখন যন্ত্রনির্ভর। কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা হয়, এরপর তা বাড়িতে আনা হয় বিভিন্ন যানবাহনের মাধ্যমে। শ্যালো ইঞ্জিনচালিত এসব যানও ধান তোলার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় ধান কাটা ও মাড়াইয়ে দেরি হচ্ছে। আবার এ বছর বৃৃষ্টিপাত কম হয়েছে। আগামী বোরো মৌসুমে অনেক বেশি সেচের প্রয়োজন হবে। টাকা বাড়িয়ে না দেয়া পর্যন্ত শ্যালো ইঞ্জিনমালিকরা সেচ দিতে রাজি না। এভাবে ডিজেলের দাম বাড়লে তাদের কী উপায় হবে সে প্রশ্ন রাখেন তিনি। বাড়তি খরচ করলে সে অনুযায়ী দাম পাওয়া যাবে কিনা তা এখন মূল দুশ্চিন্তার বিষয়। আবার খরচ পোষাতে উৎপাদন কমিয়ে দেবেন কিনা সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবছেন বলে জানান তিনি। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে উফশী, হাইব্রিড ও স্থানীয় জাত মিলিয়ে আবাদ হয়েছে প্রায় ৪৮ লাখ ৭২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। চলতি অর্থবছরে সেটি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু সেচের জন্য তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবারো বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে শঙ্কা তৈরি করবে। বোরো ধানের আবাদ ছাড়াও সবজি, তেল, ডালজাতীয় খাদ্য ও দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হবে। এসব খাদ্য পণ্য উৎপাদনেও সেচের ব্যবহার হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য বলছে, গত বোরো সেচ মৌসুমে ছয় মাসে প্রয়োজন হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ টন ডিজেল। গত অর্থবছরের চাহিদার সমপরিমাণ ডিজেলের ব্যবহার হতে পারে চলতি বছর। এর মধ্যে চলতি বছরের ডিসেম্বরে তেলের চাহিদা থাকবে ১ লাখ ৯৪ হাজার টন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ২ লাখ ৩৩ হাজার, ফেব্রুয়ারিতে ৪ লাখ ৬৬ হাজার, মার্চে ৫ লাখ ৫ হাজার, এপ্রিলে সাড়ে তিন লাখ ও মে মাসে প্রায় এক লাখ টন। এসব ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়লে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে কৃষকের পণ্য পরিবহন ও যান্ত্রিকীকরণের বাড়তি খরচও যুক্ত হবে। ফলে সেচ ও পরিবহন ব্যয়ের বাড়তি খরচ মিলিয়ে কৃষকের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যয় হতে পারে। অবশ্য এ বাড়তি খরচ মেটাতে হলে কৃষককে বাড়তি দাম দিতে হবে। বাড়তি দাম দিলে চালের দাম বাড়বে। ফলে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জাতীয় মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বোরো ধানের আবাদ পুরোটাই সেচনির্ভর। কাজেই ডিজেলের বাড়তি দাম আমাদের কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আবার কৃষকের বাড়তি উৎপাদন খরচ মেটাতে হলে অবশ্যই যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারেন। এতে আমাদের খাদ্যশস্যে আমদানিনির্ভরতা বাড়তে পারে। ফলে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়া একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিতে পারে তেমনি সামনের দিনে খাদ্য আমদানির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।