নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগযোগ্য তারল্য আছে ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও এখনো বাড়েনি। যদিও এর মধ্যেই তারল্যের চাপ তৈরি হয়েছে মুদ্রাবাজারে। গত এক সপ্তাহে প্রতিদিনই কলমানি বাজারে লেনদেন হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। চাহিদা তুঙ্গে ওঠায় গতকাল কলমানি বাজারে সুদহার সাড়ে ৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। যদিও এক মাস আগেও দেশের কলমানি বাজারে সুদহার ছিল ইতিহাসের সর্বনিম্নে।
দেশের অনেক বেসরকারি ব্যাংকের হাতে সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণের মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। এজন্য বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ রেপো ও অ্যাশিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) নিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এক্ষেত্রে সামনের সারিতে আছে দেশের চতুর্থ প্রজন্মের বেশ কয়েকটি ব্যাংক। তৃতীয় প্রজন্মের অনেক ব্যাংকেও শুরু হয়েছে তারল্য সংকট।
করোনাকালে রেকর্ড আমানত প্রবৃদ্ধির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে মেয়াদি আমানতের সুদহার ইতিহাসের সর্বনিম্নে নামিয়ে এনেছিল অনেক বেসরকারি ব্যাংক। কোনো কোনো ব্যাংক তিন-ছয় মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার নামিয়ে এনেছিল ২ শতাংশের ঘরে। বর্তমানে ওই ব্যাংকগুলোই কলমানিতে টাকা নেয়ার জন্য প্রতিদিন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে জমা হয়েছে রেকর্ড অলস তারল্য। অথচ বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় অনেক ব্যাংকেও টাকা নেই। বেশি সুদে আমানত না নিয়ে কলমানি বাজার থেকে সস্তায় ধার নেয়ার নীতিতে চলছিল বেসরকারি অনেক ব্যাংকই। এখন অতিরিক্ত তারল্যের অধিকারী ব্যাংকগুলো ট্রেজারি নীতি বদলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে বেসরকারি বেশকিছু ব্যাংকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত বা অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। গত জুনে অতিরিক্ত এ তারল্যের পরিমাণ ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। রেকর্ড পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্যের মধ্যে ৯৮ হাজার ৮১৬ কোটি টাকাই আছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের হাতে। বর্তমানে কলমানি বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ ব্যাংকগুলোই নেতৃত্বের আসনে রয়েছে। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক একাই বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি কলমানি, রেপো ও শর্ট নোটিস ডিপোজিট হিসেবে ধার দিয়েছে।
হঠাৎ করেই কলমানি বাজারে সুদহার সাড়ে ৪ শতাংশে উঠে যাওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলামও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, করোনাকালের পুরো সময়জুড়েও কলমানি বাজারে তারল্যের এত চাপ দেখা যায়নি। কিন্তু কয়েক দিন ধরেই কলমানি বাজারে সুদহার বেড়েছে।
তবে মুদ্রাবাজারে যে চাপ তৈরি হয়েছে, সেটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলেই মনে করছেন তিনি।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলো সুদহার কমিয়ে দেয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতের সর্বনিম্ন সুদ নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা বলেছি, কোনো ব্যাংক মেয়াদি আমানতের জন্য মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম সুদ দিতে পারবে না। এ কারণে অনেক ব্যাংক আমানত নেয়া কমিয়ে দিয়ে কলমানি বাজার থেকে ধার নেয়াকে প্রাধান্য দিয়েছে। এখন ওই ব্যাংকগুলোই কলমানি বাজার থেকে বেশি সুদে টাকা নিতে বাধ্য হচ্ছে।
মুদ্রাবাজারে তারল্যের চাপ তৈরি হওয়ায় প্রভাব পড়েছে সরকারি বিল-বন্ডে। এক মাস ধরে ট্রেজারি বিল-বন্ডের ইল্ড রেট বাড়ছে। এমনকি গতকাল ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের নিলাম ডেকে ব্যাংকগুলো থেকে প্রত্যাশিত সাড়াও পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিলামে ২ হাজার কোটি টাকা তোলার কথা থাকলেও মাত্র ৪০০ কোটি টাকার বিড হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। অতিরিক্ত তারল্যের চাপে এক মাস আগেও ট্রেজারি বিলের ইল্ড রেট নেমে এসেছিল ২ শতাংশের নিচে। বর্তমানে বিভিন্ন মেয়াদি বিলের ইল্ড রেট ৩ শতাংশের ঊর্ধ্বে উঠেছে। ট্রেজারি বন্ডের ইল্ড রেট উঠে গেছে ৫ শতাংশের ঊর্ধ্বে।
অলস তারল্যের চাপ থেকে ব্যাংকগুলোকে সুরক্ষা দিতে গত আগস্টে উদ্যোগী হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য মাসব্যাপী ৭, ১৪ ও ৩০ দিন মেয়াদি বিলের নিলাম কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ওই নিলামের মাধ্যমে মুদ্রাবাজার থেকে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছিল বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ১৬৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমেও বাজার থেকে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। মুদ্রাবাজারে চাপ সৃষ্টির পেছনে এ দুটি কারণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী।
আরফান আলী বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি তেলসহ বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ছে। ফলে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। মূল্যস্ফীতি মুদ্রাবাজারে তারল্যের চাপ তৈরি করে। বিল ও ডলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে টাকা তুলেছে। আগামীতে ডলারের বাজার আরো বেশি তেজি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক গতিতে ফেরায় বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা অনেক বাড়বে। সব মিলিয়ে মুদ্রাবাজারে তারল্যের যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে সেটি সাময়িক হবে বলে মনে হচ্ছে না।