বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যানের ১৫ মাসের কারাদণ্ড

বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যানের ১৫ মাসের কারাদণ্ড

ঢাকা ব্যাংকসহ তিন ব্যাংকের মামলায় দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীরকে ১৫ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। গতকাল অর্থঋণ আদালতের যুগ্ম জেলা জজ মুজাহিদুর রহমান এ আদেশ দেন। এর আগে ৩ নভেম্বর সিটি ব্যাংকের মামলায় তাকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

অর্থঋণ আদালতের সেরেস্তাদার মুক্তাদির মাওলা জানিয়েছেন, ঢাকা ব্যাংকের অর্থজারি মামলায় ফেরদৌস খানকে পাঁচ মাসের দেওয়ানি আটকাদেশের নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি সিটি ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকের মামলায়ও পাঁচ মাস করে মোট ১৫ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্ত্বেও তাদের ধরতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আদালত। এর পর পরই একাধিক ঋণখেলাপি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীর সিটি ব্যাংকের মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর ঢাকা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মামলায়ও তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আদালত ঢাকা ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকের আবেদন মঞ্জুর করেন এবং ডিক্রিদার ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়ানি আটকাদেশ দেন।

আদালতের নথি পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ফেরদৌস খান আলমগীরের বিরুদ্ধে ঢাকা ব্যাংকের বর্তমান পাওনা ৭৭ কোটি টাকা। ঢাকা ব্যাংকের চেক প্রতারণার অভিযোগে ১৬ কোটি টাকার মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। এছাড়াও সিটি ব্যাংকের ৩২ কোটি টাকার অর্থজারি মামলা, সিটি ব্যাংকের চেক প্রতারণার অভিযোগে করা ১৪ কোটি টাকার এসটি মামলাও বিচারাধীন।

অন্যদিকে ব্যাংক এশিয়ার ২২ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংকের ১৫ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৭৯ লাখ টাকার চেক প্রতারণার অভিযোগে করা মামলাগুলোর বিচারও চলছে। আরো বিচারাধীন রয়েছে ৭৯ লাখ টাকার চেক প্রতারণার মামলা, ৭৯ লাখ টাকার এসটি মামলা ও ১ কোটি টাকার এসটি মামলা। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের এ ব্যবসায়ীর কাছে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আটকা রয়েছে।

সিটি ব্যাংকের আইনজীবী মোহাম্মদ নাঈম ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, বিচারক নথিপত্র পর্যালোচনা করে বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীরকে সিটি ব্যাংকসহ তিনটি ব্যাংকের মামলায় পাঁচ মাস করে সর্বমোট ১৫ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। আদালতের রায়ের পাশাপাশি প্রশাসন যদি ঋণখেলাপিদের গ্রেফতারে সচেষ্ট হয়, তবে ব্যাংকের টাকা আদায় কার্যক্রম আরো বেগবান হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাগদাদ গ্রুপের কর্ণধার চট্টগ্রামের রাউজানের ফেরদৌস খান আলমগীর। তাঁর পিতা আইয়ুব খান ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের সারের ডিলার। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাটে ছিল তাদের কার্যালয়। এক সময় সারের ব্যবসা থেকে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় আসেন আলমগীর ও তার সহোদর। পরে ফিশিং, আবাসন, পরিবহনসহ আরো কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তারা। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মেসার্স আলমগীর ব্রাদার্স, বাগদাদ ট্রেডিং, ফেরদৌস এন্টারপ্রাইজ, বাগদাদ এক্সিম করপোরেশন, বাগদাদ পরিবহন, বাগদাদ প্রপার্টিজ। এরপর ব্যাংকগুলো থেকে একের পর এক ঋণ সুবিধা নেন। প্রথমদিকে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ভালো করে ব্যবসা করলেও পরে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে গড়িমসি শুরু করেন। একপর্যায়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ আটকে যায়।

ব্যাংক এশিয়া শেখ মুজিব রোড শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০০৩ সালের দিকে তাদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন বাগদাদ গ্রুপের কর্ণধার ফেরদৌস খান। তখন পর্যন্ত সরকারি আদেশে সার আমদানির ব্যবসা করত মেসার্স আলমগীর ব্রাদার্স। সার আমদানি করতে ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করলেও এ ঋণের টাকা ব্যবহার করা হতো অন্যান্য খাতে। এতে অন্যান্য খাতে ব্যবসায় লোকসান হলে ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির বন্ধক রাখা সম্পত্তিতেও মালিকানা নিয়ে ঝামেলা রয়েছে। ঋণখেলাপির তালিকায় থাকা পরিবারটির একাধিক সদস্য ব্যাংকের টাকা না দিয়ে কানাডায় বাড়ি করে আবাস গড়েছেন। ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট খেলাপি ঋণের ৯ মামলায় ফেরদৌস খানের স্ত্রী মেহেরুন নেছাকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। মেহেরুন নেছা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের বড় ভাই নবী দোভাষের মেয়ে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের চেক প্রতারণার নয় মামলায় মেহেরুন নেছার সাজা হয়েছে। গ্রেফতারের পর নয় মাস সাজা ভোগ করেন তিনি।

অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত থাকলেও ফেরদৌস খান আলোচনায় আসেন মূলত বাগদাদ এক্সপ্রেস নামের বিলাসবহুল যাত্রীবাহী বাস সার্ভিস চালুর মাধ্যমে। ২০১৩ সালের দিকে ১৫টি বিলাসবহুল মার্সিডিজ এসি বাস দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটসহ বিভিন্ন রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। তবে অন্যান্য ব্যবসার মতো ব্যাংকের টাকায় কেনা বাসগুলোর ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ না করে কয়েক বছর পর বাস চলাচলই বন্ধ করে দেয়া হয়। যদিও চলতি বছরের ১১ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ এলাকার গ্যারেজে আগুন লেগে ১১টি মার্সিডিজ এসি বাস পুড়ে যায়। সর্বশেষ ১৯ মার্চ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো আবেদন জমা পড়েনি। নিয়ম অনুযায়ী, ঘটনাস্থল থেকে অগ্নিকাণ্ডের কোনো সূত্র সংগ্রহ করা না গেলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফায়ার সার্ভিস তদন্তে নামে। কিন্তু কেউ আবেদন না করায় দীর্ঘদিন ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম জেলার মহানগর ইউনিট।

বাগদাদ পরিবহনে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এভিপি ও হেড অব ব্রাঞ্চ (প্রবর্তক শাখা) মোহাম্মদ ওসমান জানান, পরিবহন খাতে ব্যবসা করতে ২০১৩ সালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় বাগদাদ গ্রুপ। ব্যাংকের টাকায় বাগদাদ এক্সপ্রেস নামে বিলাসবহুল মার্সিডিজ বাসের ব্যবসা করলেও গত আট বছরে ব্যাংকের টাকা শোধ করেননি ফেরদৌস খান। বর্তমানে বাগদাদ গ্রুপের কাছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক প্রবর্তক মোড় শাখার ৩৪ কোটি টাকা পাওনা আটকে রয়েছে। এ পাওনা আদায়ে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি সীতাকুণ্ডের সলিমপুর এলাকার ৬০ শতক জমি নিলামে তোলে। তবে তাতেও উপযুক্ত দরদাতা পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, ২০০৮ সালের দিকে রূপালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে এলটিআর, টার্ম লোনসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে মেসার্স বাগদাদ ট্রেডিং। কিন্তু ঋণ সুবিধা গ্রহণের পর পরই কিস্তি পরিশোধে গড়িমসি করে প্রতিষ্ঠানটি। বহু চেষ্টার পরও ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়ায় ২০১০ সালেই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা দায়ের করে ব্যাংকটি। ওই মামলায় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও তিন সহোদর ফেরদৌস খান আলমগীর, তানভীর খান আলমগীর ও আজাদ খান আলমগীরকে বিবাদী করা হয়। বর্তমানে বাগদাদ ট্রেডিংয়ের কাছে রূপালী ব্যাংকের মোট পাওনা ৪৬ কোটি টাকা। মামলার ১০ বছর পার হলেও এখনো টাকা আদায় সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

Others