সাইবার জগতে হয়রানির শিকার হওয়া অধিকাংশ নারীই লজ্জা কিংবা ভয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন না। বিষয়টি চেপে যান। সমাজ কিংবা সম্মানহানির ভয়ে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিলেও পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। ফলে সাইবার অপরাধ দিন দিন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
নারীর জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নির্মাণে ভূমিকা রাখতে এক বছর আগে যাত্রা শুরু করে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’।
গতকাল মঙ্গলবার পুলিশের এই ইউনিটটির প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক বছরে ইউনিটটির কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাইবার হয়রানির শিকার অধিকাংশ নারীই অভিযোগ কিংবা মামলা দায়ের করতে অনীহা প্রকাশ করেন।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে মামলা করেছেন মাত্র ১২% নারী:
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগী। এরমধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছেন। আর ১৩ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তে আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছেন।
সূত্র আরও জানায়, পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ হাজার ২৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছেন। হয়রানি সংক্রান্ত ১২ হাজার ৬৪১ অভিযোগের মধ্যে ৮ হাজার ২২১ জনকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ এবং সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
ফেক আইডি ও ব্যক্তিগত বিষয়ে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ বেশি :
পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, গত এক বছরে যারা এখানে অভিযোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। যা মোট অভিযোগের ৪৩ শতাংশ বা ৫ হাজার ৪৭৫ জন।
এছাড়া ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে এক হাজার ৮৮৪ জন নারীকে। আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানি করা হয় ৯৯২ জনকে। অন্যান্য উপায়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন এক হাজার ৫১৮ জন।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৫৮% তরুণী:
সাইবার হয়রানির শিকার হয়ে যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের মধ্যে ৫৮ ভাগই তরুণী, তাদের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে।
গত এক বছরের পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা গেছে, অভিযোগকারীর শতকরা ১৬ ভাগ ১৮ বছরের কম বয়সী। ২৫-৩০ এর মধ্যে ভুক্তভোগী রয়েছেন ২০ ভাগ এবং ৬ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি।
ঢাকা বিভাগেই ৬৪ শতাংশ অভিযোগ:
গত এক বছরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে ঢাকা বিভাগ থেকে, যা মোট অভিযোগের ৬৪ শতাংশ।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৭ শতাংশ; খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ৪ শতাংশ; বরিশাল থেকে ৩ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ থেকে ২ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন।
ভিকটিম হলে লুকিয়ে থাকবেন না : আইজিপি
সাইবার ওয়ার্ল্ডে কোনো নারী ভিকটিম হলে লুকিয়ে না থেকে সহায়তা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। গতকাল দুপুরে পুলিশ সদর দফতরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
এ সময় পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজি, ডিআইজি এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সেবাগ্রহীতারা উপস্থিত ছিলেন। সারা দেশ থেকে পুলিশের সব ইউনিট ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিল।
আইজিপি বলেন, কোনো নারী-পুরুষ ভিকটিম হোক তা আমরা চাই না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো নারী যদি ভিকটিম হয়েই যান, তাহলে সেটি লুকিয়ে রাখবেন না। আমরা চাই অপরাধীদের শাস্তি হোক।
সামাজিক কারণে অনেকেই অভিযোগ করেন না :
পুলিশ প্রধান বলেন, সামাজিক কারণে অনেকেই এ বিষয়ে মামলা-মোকদ্দমা করতে চান না। তরুণীরা মূলত ভিকটিম হচ্ছে বেশি। সমাজ বা মানহানির ভয়ে তারা এটা করতে চায় না। সমস্যা হয় যখন অপরাধীকে শনাক্ত করার পর ভিকটিম ব্যাকঅফ করে। এটা মোকাবিলা করতে হবে। সামাজিক ট্যাবু ভাঙতে হবে।
তিনি বলেন, সাইবার ওয়ার্ল্ডে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডায় রাষ্ট্র, ব্যক্তি তথা সমাজ ব্যবস্থা ভিকটিম হচ্ছে। সাইবার বুলিং-সাইবার সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে নারীরা সবচেয়ে বড় ভিকটিম। এই প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে বুঝতেই পারেন না, তারা এই সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। যারা এই সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন তারাই বুঝতে পারেন, তারা কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন। এর ফলে ব্যক্তির মানবিক-মানসিক বিপর্যয় ঘটে।
ইন্টারনেট ব্যবহারে আরও সতর্ক হতে হবে:
ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অনুষ্ঠানে আইজিপি বলেন, এক তরুণী ফেসবুকে নিজের বেশকিছু ছবি আপলোড করেছেন, অথচ তিনি জানেন না ফেসবুকের সেফটি কী? তার অজান্তেই কেউ একজন ছবিগুলো কপি করে একটি ন্যুড কমার্শিয়াল সাইটে দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। ওই নারী তখনই জানতে পেরেছেন, যখন বিয়ে-সাদির বিষয়টি এসেছে। পরে ওই নারীকে আমরা সাইবার সাপোর্ট দিয়ে সাইটটি ব্লক করে সহায়তা করার চেষ্টা করেছি।
আমি মনে করি, ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে। ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক মাধ্যমে একবার যদি ছড়িয়ে পড়ে কোটি কোটি মানুষের কব্জায় চলে যায়। হয়তো একটা আইডি ব্লক করা গেল। কিন্তু ওই আইডি থেকে কোটি কোটি শেয়ার-ট্যাগ হয়ে যায়।
যে ঝুঁকি স্বাভাবিক অপরাধের চেয়েও বেশি!
বেনজীর আহমেদ বলেন, যত বেশি আমাদের দেশে ডেটাবেজ ব্যবহৃত হবে তত বেশি ঝুঁকি বাড়বে। কিছুদিন আগে আমাদের দেশে ই-কমার্সের জোয়ার বয়ে গেল। সেখানে কেনাটাকা করতে গিয়ে কোটি কোটি মানুষ তাদের প্রাইভেট তথ্য দিয়ে দিয়েছি।
এসব ই-কমার্স সাইটের কাছে এখন লাখ লাখ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে। এ তথ্যের সিকিউরিটি কী? সেসব ফোন নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং, ঠিকানা যদি থার্ড পার্টির হাতে যায় তাহলে সেসব আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। এই ঝুঁকি স্বাভাবিক অপরাধের চেয়েও বেশি।
তাই যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন সেখানে কোনো ধরনের অপরিচিত মানুষকে অ্যাক্সেস দেবেন না। কারও বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে আপনার নিজস্ব নেটওয়ার্কে কাউকে এন্ট্রি দেবেন না। দেখা গেল ফেসবুকে কারও সঙ্গে এক-দুইদিনের পরিচয়, দেখা করতে বেরিয়ে পড়েন। সেসব ক্ষেত্রে অনেকে ভিকটিম হয়েছেন।