আলমগীর হোসেন
‘আছি তো আমরা আছিই তো…’, আস্থা বা ভরসামূলক এমনই চটকদার কথায় বিজ্ঞাপন ও রিংটোন তৈরি করেছিল ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট। কিন্তু ওইসব কথা যে কেবল প্রতারণা বা আকৃষ্ট করার জন্য তা এবার যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন গ্রাহকরা। টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ না করায় হাজার হাজার গ্রাহক এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। মামলা করলেও টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনা কিংবা নানা অনিশ্চয়তার শঙ্কায় ভিন্ন প্রক্রিয়ায় উপায় খুঁজছেন গ্রাহকরা। বিশেষ করে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের দিয়ে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেই টাকা ফেরত পাওয়ার উপায় খুঁজছেন বেশিরভাগ গ্রাহক। সে কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারেও ছুটে বেড়াচ্ছেন তারা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে থানায় দেখা যায়, মাহমুদুল হাসান সুজন নামে শরীয়তপুরের এক যুবক রাজধানীর বনানী থানার সামনে অপেক্ষমাণ। জানতে চাইলে সুজন বলেন, ‘৩০ শতাংশ মূল্য ছাড়ের সুবিধায় একটি দামি বাইকের জন্য আলেশা মার্টকে ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলাম গত জুন মাসে। কিন্তু কথামতো বাইকও দেয়নি, আবার টাকাও ফেরত দেয়নি আলেশা মার্ট। সাম্প্রতিক ঝামেলা তৈরি হলে ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাদের যৌক্তিকভাবে চাপ সৃষ্টি করলে একটি চেক দেওয়া হয়। এরপর বলেও দেয়- ‘যে কথা না বলে জমা দেবেন না, তা হলে টাকা পাবেন না।’ এরপরও কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তারা টাকা ছাড় দেয়নি। তাই বিপদে পড়ে পুলিশের কাছে আসা। পুলিশ একট চাপ সৃষ্টি করলেই টাকা ফেরত পাব।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মো. আসাদুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ‘টাকা তুলে দেওয়ার বিষয়ে অনেকেই বলছেন। কিন্তু এখানে পুলিশের খুব বেশি কিছু করার নেই। মামলা হলে পুলিশ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা) আলেশা মার্ট বা কর্তৃপক্ষের কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। তবে শোনা যাচ্ছে, কেউ টাকা পাচ্ছে আবার কেউ পাচ্ছে না।’
পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা সময়ের আলোকে জানান, একশ্রেণির গ্রাহক লোভে পড়ে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে টাকা বিনিয়োগ করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনলাইনভিত্তিক এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা করছে। কিছু মানুষ লাভবান হলেও বেশিরভাগ গ্রাহকই প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। চটকদার বিজ্ঞাপন ও প্রলোভনে পড়ে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে পরে তারা আবার দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ এসব ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে পুলিশকে। ই-ভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ আরও একাধিক প্রতিষ্ঠানের পর এখন আলেশা মার্ট নিয়েও বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন মহলের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিও কিছু কিছু গ্রাহকের পক্ষে টাকা উঠিয়ে দিতে তদবির বা ফোন করছেন। এ নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারাও পড়েছেন বিব্রতকর বা বেকায়দা অবস্থায়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে দেখা যায়- বনানী থানার ওসির কক্ষ থেকে শুরু করে আশপাশে বেশ কয়েকজনের আনাগোনা। যাদের অধিকাংশই আলেশা মার্টের ভুক্তভোগী গ্রাহক। নাম প্রকাশ না করে এ সময় কয়েকজন ভুক্তভোগী গ্রাহক সময়ের আলোকে বলেন, বেশিরভাগ গ্রাহক ৩-৫ লাখ টাকার। যাদের অধিকাংশ মোটরসাইকেল কেনার জন্য টাকা জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। টাকা ফেরত চাইলেও আলেশা মার্ট টালবাহানা করে চলেছে। বনানীতে আলেশা মার্টের প্রধান কার্যালয়ের সামনে এমন অনেক গ্রাহক জড়ো হয়ে কান্নাকাটি করছেন, দেখলে নিজের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীও আলেশা মার্টে টাকা দিয়ে ফেঁসে গেছেন।
ওই ভুক্তভোগীরা আরও বলেন, আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মনজুর আলম শিকদার এখনও গ্রাহকদের আশ^াস দিয়ে যাচ্ছেন, কাউকে কাউকে চাপের কারণে টাকা ফেরতও দিচ্ছেন। কিন্তু এখন চেয়ারম্যানকেও আর পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক জান্নাতুন নাহারের সঙ্গে যেসব গ্রাহক যোগাযোগ করছেন তাদের সঙ্গেই অত্যন্ত খারাপ আচরণ করছেন তিনি। গ্রাহকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ধমকিও দিচ্ছেন জান্নাতুন নাহার। বর্তমানে আলেশা মার্টের চেয়ারম্যানকে আড়ালে রেখে গ্রাহকদের মুখোমুখি হচ্ছেন এই জান্নাতুন নাহার।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে বৃহস্পতিবার আলেশা মার্টের নির্বাহী পরিচালক জান্নাতুন নাহারকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ফোন ধরার অনুরোধ জানিয়ে এসএমএস পাঠালে কিছু পরে তিনি ফিরতি মেসেজ পাঠান। এতে তিনি লিখেছেন, ‘অনেক প্রেশারে আছি। কল মি টুমরো।’ এ ছাড়াও আলেশা মার্টের জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বপালনকারী কাজী তানজীলুর রহমানকেও একাধিকবার ফোন করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আলেশা মার্ট ৮ হাজারের বেশি মোটরসাইকেলের অর্ডার নিয়ে ডেলিভারি না দিয়ে মাসের পর মাস গ্রাহকদের ঘোরাচ্ছে। এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের আরও অন্তত ৫ হাজার পণ্যের অর্ডারের বেশিরভাগই আটকে রাখা হয়েছে। অথচ এসব পণ্যের অর্ডার দেওয়া গ্রাহকরা আলেশা মার্টকে অগ্রিম টাকাও পরিশোধ করেছেন অনেক আগেই। শুধু মোটরসাইকেলের অর্ডার দেওয়া গ্রাহকেরই ১৪৬ কোটি টাকা আটকে রেখেছে আলেশা মার্ট নামে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে পূর্বঘোষিত সংবাদ সম্মেলন করার কথা বলেও এতে অংশ নেননি আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মনজুর আলম শিকদার। অসুস্থতার কথা বলে তিনি সংবাদ সম্মেলনে আসেননি। তবে গ্রাহকের দাবি, পূর্বের মতোই নতুন করে আলেশা মার্ট গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।
অন্যদিকে গতকাল বনানী ও তেজগাঁওয়ের ওইসব কার্যালয় ও শোরুম-গুদাম এলাকায় বেশ কিছু গ্রাহক জড়ো হন। বনানী ছাড়াও তেজগাঁও এলাকাতেও আলেশা মার্টের একাধিক অফিস রয়েছে। ভুক্তভোগী গ্রাহকরা কখন, কীভাবে টাকা বা পণ্য পাবেন সে অপেক্ষায় থাকলেও সন্তোষজনক জবাব পাননি।
তবে আলেশার কর্মকর্তারা অপেক্ষমাণ গ্রাহকদের জানিয়েছেন, আলেশা মার্টের চেয়ারম্যানের আরও বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেদিক থেকে অর্থ এনে ধীরে ধীরে পাওনা পরিশোধ শুরু করেছেন। গ্রাহকরা ধৈর্য ধরলে টাকা ফেরত পাবেন। যদিও কর্মকর্তাদের এসব কথায় আর ভরসা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। তাই দিশেহারা গ্রাহকরা টাকা ফেরত পেতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বনানী থানার ওসি নুরে আজম মিয়া সময়ের আলোকে বলেন, আলেশা মার্ট থেকে টাকা ফেরত পেতে প্রচুর ফোন আসছে। সশরীরে অনেকেই থানায় আসছেন। কিন্তু আর্থিক বা বাণিজ্যিক এ ধরনের বিষয়ে সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে পুলিশের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তারপরও মানবিক ও বাস্তবতার কারণে আন্তরিকভাবে যতটুকু সম্ভব বিষয়গুলো দেখা হচ্ছে।