নিজস্ব প্রতিবেদক
অর্থপাচারে জড়িত ৪৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবেদনে ‘তথাকথিত ধনকুবের’ মুসা বিন শমসের ও ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টুর নামও রয়েছে। আজ রবিবার এই তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করা হবে।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বিষয়টি জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। তিনি বলেন, একটি সুয়োমটো রুল (কোনো বিষয়ে আদালতের স্বপ্রণোদিত আদেশ) ও একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট অর্থপাচারকারীদের তালিকা চেয়েছিলেন। সেই তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। রবিবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে এই তালিকা দাখিল করা হবে।
পেরাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারির উদ্ধৃতি দিয়ে দুদকের তালিকায় আবদুল আউয়াল মিন্টু ও তার পরিবারের সদস্য নাসরিন ফাতেমা আউয়াল, তাবিথ আউয়াল, তাফসির আউয়াল ও তাজওয়ার মো. আউয়ালের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া তালিকায় নাম রয়েছে মোগল ফরিদা ওয়াই, ৮০-৭২, তাইরন পিআই, জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক, ইউএসএ; শহিদ উল্লাহ, ২৩৫, স্যাডল রজি পেলস, দ্য উড ল্যান্ডস, টেক্সাস, ইউএসএ; চৌধুরী ফয়সাল, বাড়ি ২৩, রোড ২৩, ব্লক-বি, বনানী, ঢাকা; আহমাদ সামির, অ্যাপার্টমেন্ট ৪বি, ১৫ ইউনাইটেড নেশানস রোড, বারিধারা, ঢাকা; ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, ৫০ মহাখালী বা/এ, ঢাকা; মুসা বিন শমসের, ভেনাস ওভারসিজ কোং, হোল্ডিং ব্লক-আই, বনানী, ঢাকা; ফজলে এলাহী, ডাইনামিক এনার্জি, হোল্ডিং বাড়ি ৪২৪, রোড ০৭, বারিধারা ডিওএইচএস, ঢাকা; কেএইচ আসাদুল ইসলাম, ইন্ট্রিপিড গ্রুপ, ধানমন্ডি, ঢাকা; জুলফিকার আহমেদ, খালেদা শিপিং কোম্পানি, বাড়ি ১৩২, রোড ০৫, ধানমন্ডি আ/এ, ঢাকা; তাজুল ইসলাম তাজুল, জেমিকো ট্রেড ইন্টা. চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ; মোহাম্মদ মালেক, বেঙ্গল শিপিং লাইনস, ১০১ আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম; ইমরান রহমান, ওসান আইস শিপিং কোম্পানি, ইপিজেড ঢাকা; মোহাম্মদ এ আউয়াল, শামস শিপিং লিমিটেড, ৭৭, মাওলানা শওকত আলী রোড, লালখান, চট্টগ্রাম; এরিক জনসন আনড্রেস উইলসন, ডব্লিউএমজি লিমিটেড, বাড়ি ১৪, রোড ১৩, সেক্টর ৪, উত্তরা, ঢাকা; ফারহান ইয়াকুবুর রহমান, ইন্ট্রিডিপ গ্রুপ, বাড়ি ৫, রোড ৫১, গুলশান, ঢাকা; তাজুল ইসলাম, জেমিকো ট্রেড ইন্টা., বালুর মাঠ, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ; আমানুল্লাহ চাগলা, পদ্মা টেক্সটাইল, বাড়ি ৪৫৮, লেন-৮, ডিওএইচএস, বারিধারা, ঢাকা; মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান, নিউটেকনোলজি ইনভেস্টমেন্ট, মস্কো, রাশিয়া; মোহাম্মদ রেজাউল হক, মাল্টা; মোহাম্মদ কামাল ভুইয়া, তুহিন-সুমন, জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যানশাল, বালুর মাঠ, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ; মাহতাবা রহমান, সেলকন শিপিং কোম্পানি, বাড়ি ৮৭-এ, রোড ০৬, ডিওএইচএস, বনানী, ঢাকা; ফারুক পালওয়ান, জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নারায়ণগঞ্জ; মাহমুদ হোসাইন, গ্লোবাল এডুকেশন সিস্টেম, আয়ারল্যান্ড; শাহনাজ হুদা রাজ্জাক, সাউদার্ন আইস শিপিং কোম্পানি, ঢাকা ইপিজেড।
পানামা পেপারসে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে দুদকের তালিকায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিডেটের ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী, সেতু করপোরেশনের পরিচালক উম্মে রুবানা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সিডব্লিউএনের আজমত মঈন, গুলশানের সালমা হক, এসএম জোবায়দুল হক, বারিধারা কূটনৈতিক এলাকার ড. সৈয়দ সিরাজুল হক, ধানমন্ডির শরীফ জহির, গুলশানের তারিক ইকরামুল হক, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা, পরিচালক খন্দকার মঈনুল আহসান শামীম, আহমেদ ইসমাইল হোসেন ও আখতার মাহমুদ।
বাংলাদেশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে সুইস ব্যাংকসহ গোপনে বিদেশে পাচার করা অর্থ অবিলম্বে ফেরত আনতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। ব্যারিস্টার আবদুল কাইয়ুম খান ও অ্যাডভোকেট সুবীর নন্দী দাস এই রিট করেন। এতে অর্থ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেল, বাণিজ্য সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ১৫ জনকে বিবাদী করা হয়।
রিটের প্রাথমিক শুনানি করে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে বিবাদীদের চরম ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম আসছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করার জন্য বিবাদীদের প্রতি কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং এ বিষয়ে প্রতি মাসে কেন অগ্রগতি জানাতে নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
একই সঙ্গে সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের অতীতের এবং বর্তমানে এ ধরনের অর্থপাচার ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে একটি স্পেশাল কমিটি গঠনের নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে অর্থপাচারকারীদের নাম-ঠিকানা ও তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চান আদালত। সে অনুযায়ী সিআইডির পক্ষে গত ১৭ অক্টোবর হাইকোর্টে মোট ৮টি মামলার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, রিজার্ভ চুরির ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপাইনে এবং ২ কোটি ইউএস ডলার শ্রীলংকায় পাচার করা হয়। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩ কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার ডলারের মতো। তালিকায় উল্লিখিত বাকি সাতটি মামলায় পাচারকৃত মোট অর্থের পরিমাণ ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৬ টাকা। এসব অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ও ক্যাসিনোকাণ্ডের মূলহোতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বহিষ্কৃত কমিশনার মোমিনুল হক সাঈদ, রাজীব হোসেন রানা, জামাল ভাটারা, শরিফুল ইসলাম, আওলাদ হোসেন, শাজাহান বাবলু, নাজমুল আবেদীন, সোহেলা আবেদীন, একেএম জাহিদ হোসেন, এঅ্যান্ডবি আটারওয়্যার অ্যান্ড নর্ম আউটফিট অ্যান্ড একসেসরিস লিমিটেড, সিইপিজেড-চিটাগাংয়ের। তবে সাতটি মামলার মধ্যে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও এনামুল হক আরমানের বিরুদ্ধে করা মামলায় সবচেয়ে বেশি ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯১ টাকা সিঙ্গাপুরে পাচারের তথ্য রয়েছে। সব মামলা তদন্তাধীন এবং পাচারকৃত টাকা উদ্ধারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।