এস এম মুকুল
হালের বলদ, লাঙল-জোয়ালের ওপর কৃষকের ভরসার সেদিন এখন আর নেই। আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় নতুন নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে দেশের কৃষিখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এসব যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কৃষকের কমেছে শ্রম ও খরচ, অপরদিকে কয়েকগুণ বেড়েছে উৎপাদন। দেখা যাচ্ছে প্রতিনিয়তই কৃষি কাজে শ্রমিকের অভাবে কৃষকরা সঠিক সময়ে ফসল জমিতে লাগাতে না পারার ফলে কৃষকদের মাঝে কৃষি কাজে যন্ত্র ব্যবহারের ব্যাপক চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কৃষি কাজের যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। একইকারণে স্থানীয়ভাবে তৈরি এসব কৃষি যন্ত্রপাতির চাহিদার বৃদ্ধির ফলে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি কারখানা। দেশের কৃষকরা যাতে ভালোভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভালো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশীয় উৎপাদন বা শিল্প বিকাশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি এবং সুলভ মূল্যে কৃষকের কাছে দেশে উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতি পৌঁছে দিতে সরকার বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে খুচরা কৃষি যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক হার ৬৩ ভাগ থেকে কমিয়ে ১ ভাগ নির্ধারণ করেছে। এর ফলে কৃষক কম মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে পারবেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে বর্তমানে ৯৫ ভাগ জমি চাষ হচ্ছে। বালাইনাশক ব্যবহারে ৯০ ভাগ, ফসল মাড়াইয়ে ৭৫ ভাগ যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ যে সব যন্ত্রপাতির দাম কম সে সব যন্ত্রেরও ব্যবহার বেশি। এ দিকে সার প্রয়োগে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে ৩ ভাগ, চারা রোপন ১ ভাগ, ফসল কাটা ১ ভাগ, এগুলোর বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারি বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জমি চাষে এখন প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লাগলেও পিছিয়ে রয়েছে ট্রান্সপ্লান্টিং ও হারভেস্টিং। মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ জমিতে ট্রান্সপ্লান্টিং করতে ব্যবহার করা হচ্ছে যন্ত্রের। অন্যদিকে মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ জমিতে হারভেস্টিং করতে ব্যবহার করা হচ্ছে যন্ত্রের। যন্ত্রের ব্যবহার না থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন কৃষক।
বিপ্লবের হাতছানি কৃষিযন্ত্রের স্বর্ণ যুগ
১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিযন্ত্র বিপণনকারী কোম্পানি ইয়ানমার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাপানি এ প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত কৃষিযন্ত্রের বাজার বিশ্বের ১১৯টি দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে দ্বিতীয় যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। এ দেশের কৃষকেরা জমি চাষ, সেচ ও ফসল মাড়াইয়ে যন্ত্রের ব্যবহারে প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে রোপণ, ফসল কাটাসহ দ্বিতীয় পর্যায়ের যন্ত্রপাতির ব্যবহার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে ভিন্নতা আসে। বাংলাদেশে যেহেতু মাথাপিছু আয় বাড়ছে, সেহেতু কৃষি খাতে শ্রমিকসংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে নতুন ধরনের কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। পাশাপাশি সরকারও কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মোটা দাগে তিনটি কারণে দেশে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো জরুরি: কৃষিতে শ্রমিকসংকট মোকাবিলা, উৎপাদন ব্যয় কমানো ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো আর তরুণদের কৃষিতে আগ্রহী করে তোলা। ৫০০ টাকা মজুরি দিয়ে ৬০০ টাকা মণ দামের ধান চাষ সম্ভব নয়। তাই যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া কৃষকের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ হলেও কৃষি সেক্টরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর দেশে কৃষি প্রযুক্তি যান্ত্রিকীকরণে স্বর্ণযুগের আরম্ভ হয়। ঐ বছর বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর থেকে ‘কৃষি যন্ত্রপাতির মান নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ এর শর্তগুলো শিথিল করলে দেশে পাওয়ার টিলার আমদানি বেড়ে যায়। আর এভাবে কৃষি কাজে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের স্বর্ণ যুগ শুরু হতে থাকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, কৃষি যন্ত্রায়ণে বড় প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ ঘটে ১৯৯৭ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে। জানাগেছে ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ির অধীনে ২৫% ভর্তুকিতে দক্ষ কৃষি প্রকৌশলীদের দ্বারা পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, শক্তিচালিত ধান মাড়াই ও ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, গুটি ইউরিয়া অ্যাপিকেটর ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রের জনপ্রিয়করণ প্র্রকল্প চালু করা হয়। এরপর ১৩ আগস্ট ২০১৩ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ৩০% ভর্তুকিতে শ্রমিকের ঘাটতি পূরণের জন্য ধান রোপণ যন্ত্র (ট্রান্সপান্টার), পাওয়ার টিলারচালিত বীজ বপন যন্ত্র, ধান কাটার রিপার ও মাড়াই যন্ত্র ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র জনপ্রিয়করণের কাজ জোরদার করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় ভর্তুকির পরিমাণ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল থেকে হাওড় ও নিচু এলাকার জন্য ৭০% এবং বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০% বৃদ্ধি করে কৃষিযন্ত্রগুলোর জনপ্রিয় করণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। এ প্রকল্পটি জুন ২০১৯ সাল পর্যন্ত চলমান থাকবে। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি ও দাতা প্রতিষ্ঠানও কৃষি যন্ত্রায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
যান্ত্রিকীকরণে বড় হচ্ছে কৃষি-অর্থনীতি
বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও প্রয়োজনীয় সরকারি উদ্যোগ ও কার্যকরী যথাযথ অবকাঠামো না থাকায় এ সেক্টরের ক্রমবিকাশ যতটুকু গড়ে ওঠা দরকার তা গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। দেশীয় কারখানায় কৃষি যন্ত্রাংশের যন্ত্রাংশ উৎপাদন শুরু হয় আশির দশকের গোড়ার দিকে। পুরনো ঢাকার জিনজিরা, ধোলাইখাল টিপু সুলতান রোড, নারায়ণগঞ্জের ডেমরায় বিপুল পরিমাণে কৃষি যন্ত্র উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে বগুড়া, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ওয়ার্কশপে এখন প্রচুর পরিমাণে মানসম্মত যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। এসব কৃষি যন্ত্রাংশের মধ্যে পাওয়ার পাম্প, পাওয়ার টিলারের টাইন, ব্লেড, লাইনার পিস্টন, পিস্টন রিং, গজপিন ও অন্যান্য স্প্রেয়ার পাম্প বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে। এগুলো যন্ত্রাংশ তৈরির মধ্যে শুধুমাত্র বর্তমানে বগুড়ায় ৮০-৮৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের বাৎসরিক বাজার প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। দেশে কৃষিকাজে যেসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে তার বেশিরভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানির ফলে প্রতিবছর বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশিদের দিতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের ১১ হাজার কোটি টাকার প্রায় পুরো মার্কেটটাই বিদেশিদের দখলে। যন্ত্রপাতি আমদানি বাবদ এতো বড় অঙ্কের টাকা চলে যাওয়ার কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে।
জানা যায়, বিদেশি যন্ত্রাংশ আমদানি করতে দেশ প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। এতে দেশীয় কারখানাগুলোর উৎপাদিত পণ্যের বাজার চরমভাবে মার খাচ্ছে। অথচ দেশের বগুড়ায় তৈরি ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রাংশ দেশের চাহিদা মিটিয়ে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও ভারতসহ অন্যান্য দেশে রফতানি হচ্ছে। কৃষি যন্ত্রাংশ কারখানাগুলো বর্তমানে দেশের সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। দেশে অবাধ আমদানি রোধ করে এ শিল্পকে আরো গতিশীল করতে প্রয়োজন সরকারি পদক্ষেপ।
আশার কথা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি মাঠ পর্যায়ে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বারির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১০ বছরের উদ্ভাবিত হাইস্পিড রোটারি টিলার ৪,০০০টি, বারি বীজ বপন যন্ত্র ১,০০০টি, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র ১৬,০০০টি, ধান, গম কর্তন যন্ত্র ১০০টি, শস্য মাড়াই যন্ত্র ৪ লাখ, ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র ৪ হাজারটি, শস্য কর্তন যন্ত্র ২০০টি কৃষকের মাঠে সঠিক কর্মদক্ষতার সাথে কাজ করছে। দেশে ছোট বড় প্রায় ৮০০টি কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি কারখানা বারি এবং ব্রি মডেলে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করছে। এছাড়াও ৭০টি ফাউন্ডারি শপ, ১ হাজার ৫০০টি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরি কারখানা এবং ২০ হাজারটি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কারখানা এই সেক্টরের সাথে জড়িত। এর ফলে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানা গড়ে ওঠার পাশাপাশি আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মঞ্জুরুল আলমের ২০১২ সালের এক তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭১.১৬ কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রাংশ লেনদেন হয় তার মধ্যে শুধু কৃষি যন্ত্রপাতি খাতে ৮০ বিলিয়ন টাকার লেনদেন হয়। এর মধ্যে দেশে তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি খাতে লেনদেন হয় ৩৩.৮৫ বিলিয়ন টাকা। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য এমন যন্ত্রপাতি যেমন জমি চাষ ও কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের শতকরা ৯৫ ভাগ, ফসল কাটার যন্ত্র- রিপার ৯৯ ভাগ, চারা রোপণ যন্ত্র ১০০ ভাগ, কম্বাইন হারভেস্টার ১০০ ভাগ ও বীজবপন যন্ত্র ৭০ ভাগ আমদানি করতে হয়। শুধু মাড়াই কাজে ব্যবহার যন্ত্র থ্রেসার মেশিন ১০০ ভাগ দেশে তৈরি হয়। এর বিপরীতে বর্তমানে দেশে কৃষি যন্ত্র প্রস্তুতকারী অনেক শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও এসব শিল্প কারখানায় দক্ষ জনগোষ্ঠীর অভাবে এদের উৎপাদিত যন্ত্রপাতির মানও তেমন ভালো নয়, যার ফলে মাঠে কৃষিযন্ত্রের প্রয়োজনীয় কার্যদক্ষতা পাচ্ছে না কৃষকরা। এর পূর্ণ সুফল পেতে হলে যে সকল ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ দেশে প্রস্তুত হচ্ছে সেসব আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত যন্ত্রাংশের মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে দেশীয় কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন কর হ্রাস বা প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশীয় ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরি শিল্পকারখানাগুলোকে উন্নত করার লক্ষ্যে এ শিল্পে প্রয়োজনীয় মূলধনের জোগান দিয়ে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা জরুরি। এ কাজটি করতে পারলে বেকার জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এ শিল্পে যোগদানের সুযোগ পাবে। বিপুল পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
যান্ত্রিকীকরণে উৎপাদন খরচ কমে
কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই মোটরসের হিসাব অনুযায়ী, ১ একর জমি চাষে সনাতন পদ্ধতিতে খরচ হয় ৩ হাজার টাকা। এটা পাওয়ার টিলারে নেমে আসে ৩১০ টাকায়। আর টাক্টরে ৫৭৫ টাকা ব্যয়ে চাষ করা যায় সমপরিমাণ জমি। ফসল কাটার ক্ষেত্রে ১ একর জমিতে সনাতন পদ্ধতির খরচ ৮ হাজার ৪০০ টাকা। একই জমিতে ফসল কাটার যন্ত্র বা রিপার মেশিনে খরচ ৩৮৫ টাকা। কাটা ও মাড়াই বাবদ কম্বাইন্ড হারভেস্টরে ব্যয় ১ হাজার ১০০ টাকা। বিএইউর কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের এক গবেষণা অনুযায়ী, ১ হেক্টর জমিতে বীজ, জমি তৈরি, সারের দামসহ ধান রোপণে ট্র্যান্সপ্লান্টার মেশিনের খরচ ১৪ হাজার ৮৮১ টাকা। সনাতন পদ্ধতির ব্যয় ২৪ হাজার ৪৪৫ টাকা।
কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার সুফল পাচ্ছেন কৃষকরা
যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে কৃষক দিন দিন কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের ফসল উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে একটা ফসল থেকে আর একটা ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় কমে যাওয়ায় কৃষকরা বছরে এখন ২টা ফসলের স্থানে ৩টা ফসল অনায়াসেই করতে পারছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কৃষি প্রকৌশলীদের মতে, ধান ফসল যদি যান্ত্রিক উপায়ে কর্তন বা রিপার দ্বারা কর্তন করা সম্ভব হয়, তবে কৃষকদের প্রায় ৮৪৫০০০ মে. টন ধান সাশ্রয় হবে। এক গবেষণায় জানা যায়, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকার খাদ্য শস্য নষ্ট হয় শুধুমাত্র পরিকল্পিতভাবে ফসল কর্তন, ফসল কর্তনোত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে। কৃষি প্রকৌশলীদের গবেষণায় আরো জানা যায়, বিগত দশকে দেশে ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২,৫০,০০০ কোটি টাকা।
ইউএসএআইডির অর্থায়নে বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অ্যাপ্রোপ্রিয়েট স্কেল মেকানাইজেশন ইনোভেশন হাব কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে যদি ধানের চারা রোপণ করা হয়, তাহলে কৃষকের শতকরা ৫০ ভাগ চারা রোপণ খরচ বাঁচায়। রিপার ও কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা হলে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে যথাক্রমে ৩৬ ও ৫৩ ভাগ খরচ বাঁচায়। অপরদিকে সনাতন পদ্ধতিতে ধান কাটা হলে ধানের অপচয় হয় শতকরা ৬.৩৬ ভাগ। কিন্তু যন্ত্রের মাধ্যমে ধান কাটা হলে ধানের অপচয় হয় মাত্র শতকরা ১.২৭ ভাগেরও কম। ধান কাটা-পরবর্তী ধান মাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণের সঠিক পদ্ধতি বা প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে ব্যবহূত না হওয়ায় শতকরা ১৪ ভাগের ওপরে ধানের অপচয় হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধান শুকানো ও সংরক্ষণ করলে ধানের এ অপচয় ৮ ভাগে নামিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। অপর এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, কৃষিতে যন্ত্রায়ন ও কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় শতকরা ১৫ ভাগ, শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি পায় শতকরা প্রায় ২০ ভাগ, সার ও বীজের সাশ্রয় ঘটায় শতকরা প্রায় ২০ ভাগ এবং সময় ও শ্রম বাঁচায় শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ। বারির ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক জরিপে দেখা গেছে, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের শুধুমাত্র বারি গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র ও মাড়াই যন্ত্র ব্যবহারের ফলে ইউরিয়া সাশ্রয় ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সাশ্রয় বাবদ ৭৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
কৃষকের অনুপ্রেরণা সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি
কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে দেশের শস্য উৎপাদন বিগত ২৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে শস্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কৃষি যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবস্থাপানার অভাবে প্রতি বছর মোট খাদ্য শস্য উৎপাদনের ৭-১০ ভাগ অপচয় হয়।
কৃষিবান্ধব সরকারের সময় উপযোগী নীতি, ফসলের উন্নত জাত এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ফসল উৎপাদনের ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কর্তনপূর্ব, কর্তনকালীন ও কর্তনোত্তর সময়ে ফসলের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে দানাশস্যে ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ মোট উৎপাদনের ১২-১৫ ভাগ, যা ফল ও শাকসবজির ক্ষেত্রে প্রায় ২৫-৪০ ভাগ। ধারণা করা হচ্ছে কৃষি কাজের প্রতিটি স্তরে কৃষি যন্ত্র ব্যবহার নিশ্চিতকরণ করা হলে বছরে আরো ৭০ মিলিয়ন খাদ্যশস্য উৎপাদন বেশি হতো। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, উন্নত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগে শস্য উৎপাদনের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রাপ্ত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। দেখা গেছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে চাষের পর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় বীজ বপন, গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ, শস্য কর্তন, শস্য মাড়াই, শস্য ঝাড়াই সহ অন্যান্য কার্যাবলিতে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার। তাই একটা ফসল কাটার পর আর একটা ফসল লাগানোর মধ্যবর্তী সময় না কমালে কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করে ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ জমি এখন পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর দ্বারা চাষ করা হয়। আগাছা নিধন, কীটনাশক প্রয়োগ ও মাড়াই কার্যক্রম যথাক্রমে শতকরা ৬৫, ৮০ ও ৭০ ভাগ বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি যন্ত্রপাতি এবং এর খুচরা যন্ত্রাংশের একটি বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে, যার পরিমাণ যথাক্রমে ৯০৭ মিলিয়ন ও ৩০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ধান উৎপাদনে চারা রোপণ ও ধান কাটায় কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার এখনো উল্লেখযোগ্য হারে হয়নি, যা শতকরা ১ ভাগেরও কম। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে ফসল উৎপাদন, ধান কাটা ও কর্তন-পরবর্তী কাজগুলোয় সঠিক যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে অপচয় রোধ করে বাংলাদেশের জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। তারপরও এক গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭ ভাগ গম, ১২.০৫ ভাগ তেল বীজ, ২৫ ভাগ শাকসবজি এবং আলু, ১২.০৫ ভাগ ডাল ফসল এবং ১০.০৫ ভাগ মরিচ ফসলে কর্তনোত্তর ক্ষতি হয় শুধু দক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের না করার ফলে। দেশে বিপুল বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষি যন্ত্রায়ণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়ার কোনো বিকল্প নাই। একইসাথে মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবজি উৎপাদন, মৎস্য চাষ ও পশুপালনেও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।
হাজার কোটি টাকার শিল্প, লাখো মানুষের কর্মসংস্থান
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় বগুড়া শহরে গড়ে উঠেছে এক বিশাল শিল্পাঞ্চল। দেশের কৃষি যন্ত্রাংশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশের জোগানদাতা বগুড়ার ফাউন্ড্রি শিল্প। ফাউন্ড্রি মালিকরা জানান, ভারতের সাতটি রাজ্যে পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশি পণ্য। তবে বাংলাদেশের মোড়কে নয়, ওই দেশের কোম্পানির মোড়কে বিক্রি হচ্ছে। এতে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব আর দেশীয় পণ্য হারাচ্ছে স্বত্ব ও ব্র্যান্ড। জানা গেছে, বগুড়ায় যন্ত্রাংশ তৈরির ছোট একটি কারখানা গড়ে উঠেছিল ষাটের দশকে। আজ সেই বগুড়া বাংলাদেশে কৃষিযন্ত্রাংশ তৈরির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সরকারি বিশেষ কোনো সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই স্থানীয় উদ্যোক্তা ও স্বশিক্ষিত মেকানিকরা এখানে খুলেছেন সম্ভাবনার দুয়ার। এ শিল্পের সঠিক তদারক করা হলে আরো লাখো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কথিত আছে এই ধলু মেকানিক নামে এক ব্যক্তি ১৯৪০-এর দশকে বগুড়ায় প্রথম হালকা প্রকৌশল শিল্পের কারখানা স্থাপন করেন। তার দেখাদেখি পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে হালকা প্রকৌশল শিল্পের কারখানা বিস্তার লাভ করে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানকার শত শত কারখানায় তৈরি হচ্ছে কৃষি কাজে ব্যবহূত হরেক রকমের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। বগুড়ায় তৈরি এসব কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রয় করার জন্য শহরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি মার্কেট। যেখানে রয়েছে তিনশ’রও বেশি বিপণন প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও বগুড়ায় তৈরি বেশ কিছু যন্ত্রাংশ রফতানি হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত ১৯৮০ দশকে বগুড়ার এই হালকা প্রকৌশল শিল্প ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। বগুড়া অ্যাগ্রো মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড প্রসেসিং জোনের তথ্যমতে, বগুড়ায় এরকম হাজার খানেক কারখানা রয়েছে যেখানে লক্ষাধিক মানুষ কাজ করে। এখানকার এই শিল্প বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কৃষি যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রাংশের শতকরা ৭৫ ভাগ চাহিদা মেটায় যার বার্ষিক বিপণন মূল্য এক হাজার কোটি টাকার বেশি। সেই সাথে ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়।
আনোয়ারের কৃষিযন্ত্রে কমছে ব্যয়, বাড়ছে উৎপাদন
কোনো চালক ছাড়াই রিমোট কন্ট্রোলে চলা যন্ত্রের সাহায্যে জমিতে চাষাবাদ, ধান কর্তন, মাড়াই ও বস্তায় ভরার কাজ চলছে। বিশেষ করে ‘আনোয়ার এক্সেল পাওয়ার টিলার’ নামের রিমোট কন্ট্রোল পাওয়ার টিলারে সাধারণ পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের চেয়ে অতি দ্রুত ও ভালোভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। এ ধরনেরই নতুন নতুন কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদিপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন। এসব যন্ত্রে কৃষিকাজে যেমন কমছে আর্থিক, সময় ও শ্রমের অপচয়, তেমনি বাড়ছে ফসলের উৎপাদন ও দাম। ইতোমধ্যেই ব্যবহার করে উপকার পেয়েছেন অনেকে। ফলে সেগুলো ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এ অঞ্চলে। যন্ত্র ও এর কাজ দেখতে দূর-দূরান্ত থেকেও ছুটে আসছেন মানুষ। আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নতুন নতুন কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবনে আমার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নষ্ট বা ফেলে দেওয়া মেশিন কিংবা ভাঙড়ির দোকানে অব্যবহূত লোহা-লক্কড় আর যন্ত্র দিয়েই তৈরি করি এসব যন্ত্র। সহযোগিতা পেলে আরো অগ্রসর হতে পারব।’
কৃষকবান্ধব যন্ত্রপাতির উদ্ভাবক আবদুল্লাহ কেনু মিস্ত্রি
৪৪ ধরনের কৃষকবান্ধব কৃষি যন্ত্রপাতির উদ্ভাবক তিনি। নাম আবদুল্লাহ আল পাঠান। সবাই কেনু মিস্ত্রি বলেই চেনে। বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায়। স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী কেনুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কৃষকদের জন্য তিনি তৈরি করছেন কৃষিযন্ত্র। কেনু মিস্ত্রির উদ্ভাবিত কৃষিযন্ত্র স্থানীয় ও আঞ্চলিক কৃষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। নিজ এলাকার পাশাপাশি জনপ্রিয়তা বাড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের কাছেও। গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের রুকনাকান্দা গ্রামের বাসিন্দা কেনু মিস্ত্রি। জন্ম ১৯৩২ সালে। কেনু মিস্ত্রি বলেন, প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। ইরি ধানের মৌসুম। গ্রামের সব কৃষক খেতের ঘন আগাছা পরিষ্কার করতে দিশেহারা, ঘাম ঝরানো কঠোর পরিশ্রম। সারাদিন কাজ করে পাঁচজন মজুর মাত্র ৮ শতাংশ জমির আগাছা পরিষ্কার করেন। কৃষকদের এমন অবস্থা দেখে কেনু মিস্ত্রি সেই রাতে ঘুমাতে পারলেন না। সারা রাত চিন্তা করে শেষ প্রহরে কিছু লোহার পাত আর কাঠের টুকরা নিয়ে বসে পড়লেন। একটা কিছু বানানোর চেষ্টা। বানালেন কাঠের হাতলওয়ালা লোহার পাতের একটা নিড়ানিযন্ত্র। নিজেই চমৎকার নাম দিলেন ‘সেনি উইডার’। পরদিন সেই যন্ত্র দিয়ে খুব সহজে একজন মজুর দিন শেষে ১২ শতাংশ জমির আগাছা পরিষ্কার করলেন। সেখানে ইরি ধানচাষিদের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল সেই যন্ত্রের খবর! তিনি তৈরি করেছেন ধানমাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, খুব সহজে ভূমি কর্ষণের আগরযন্ত্র, গোল আলুর বীজ বপনযন্ত্র, নির্দিষ্ট দূরত্বে শস্যবীজ বপনযন্ত্র, সবজিবীজ বপনযন্ত্র, গুটিসার প্রয়োগযন্ত্র, উঁচু গাছে কীটনাশক প্রয়োগযন্ত্র, আঁঁচড়যন্ত্র। বানিয়েছেন সহজে জমিতে সেচ দেয়ার পাড়াকল, দোনা এবং পানি সেচের হাতকুন্দা। তৈরি করেছেন কাঠের ওপর শৈল্পিক নক্শা করার খোদাইনযন্ত্র, আধুনিক খন্তা, কোদাল, মাটি ও কৃষিভেদে চার ধরনের নিড়ানিযন্ত্র। গভীর কাদা থেকে সহজেই মাছ শিকারের জন্য ‘হয়ড়া’। যন্ত্রগুলো বানাতে বাঁশ, কাঠ, লোহা, ইস্পাত, স্টিল ও বাইসাইকেলের চেইন ছাড়া অন্যকোনো বিশেষ উপাদানের প্রয়োজন হয় না। কেনু মিস্ত্রির তৈরি যন্ত্রগুলো ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বলছে, বাংলাদেশের কৃষিতে কেনু মিস্ত্রির তৈরি হস্তচালিত যন্ত্রগুলো অসাধারণ মেধার পরিচায়ক। কৃষিযন্ত্রগুলো কৃষকবান্ধব। কৃষিতে শতভাগ শক্তিচালিত যন্ত্র এলেও তার তৈরি হস্তচালিত যন্ত্রগুলোর চাহিদা থাকবে। হস্তচালিত কৃষিযন্ত্রের আবেদন বাংলাদেশে কমবে না। জাদুঘরের চারটি কক্ষে রয়েছে কেনু মিস্ত্রির ২৫টি কৃষিবান্ধব যন্ত্রপাতি।