মীর মনিরুজ্জামান: পাঁচ বছর একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় কোনো সময় নয়। তবে প্রথম পাঁচ বছর যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাঁচ বছর বেশ গুরুত্বপূর্র্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত পত্রিকা দৈনিক শেয়ার বিজ কড়চা নতুনরূপে প্রকাশিত হওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ করে ছয় বছরে পা রেখেছে গত ১ ডিসেম্বর। এজন্য পত্রিকার পাঠক, এজেন্ট, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ী, মালিকপক্ষ, সংবাদকর্মীসহ জেলা প্রতিনিধি, লেখকসহ শেয়ার বিজ পরিবারের সবাইকে জানাই প্রীতি ও শুভেচ্ছা। পাঁচটি বছর প্রতিষ্ঠানটির জন্য যে যার অবস্থান থেকে অবদান রেখেছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কারণেই করোনার এ দুঃসময়েও পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। গত পাঁচ বছর সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় সংবাদ নিয়ে শেয়ার বিজ পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে। এজন্য একক কোনো কৃতিত্ব নেই, সব কৃতিত্ব শেয়ার বিজ টিমের।
স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকার পত্রিকাগুলো ছিল মূলত কোনো রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত, অথবা প্রথিতযাশা কোনো সাংবাদিকের মেধা ও শ্রমের ফসল। নিয়মিত বেতন না পেলেও রাত জেগে পত্রিকায় কাজ করে কেউ কেউ গভীর রাতে বা ভোরে ঘরে ফিরতেন। তখন ন্যায়-নীতি ও আদর্শের জন্য পত্রিকায় কাজ করতেন বেশিরভাগ কবি-সাহিত্যিক ও বাম ঘরানার রাজনীতিবিদেরা। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক পত্রিকাগুলো পাঠক হারিয়ে ফেলে। নব্বইয়ের দশকে এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে সংবাদপত্র খাতে আমূল পরিবর্তন আসে। কয়েকটা বড় শিল্পগ্রুপ পত্রিকা খাতে বিনিয়োগ করে। তাদের মধ্যে অন্যতম ট্রান্সকম গ্রুপ। তাদের বিনিয়োগের অন্যতম দৃষ্টান্ত প্রথম আলো ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার।
গত ৩০ বছরে ঢাকার পত্রিকা জগতে নাম লিখিয়েছে শতাধিক পত্রিকা। এর মধ্যে অর্ধশত পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এসব পত্রিকার মধ্যে অল্প কয়েকটি বাদে প্রায় সব পত্রিকাই কোনো না কোনো ব্যবসায়ী বা শিল্পগ্রুপের মালিকানায় চলে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ছোট কোনো উদ্যোগের ক্ষেত্রে টিকে থাকা বেশ কঠিন। তার পরও কিছু পত্রিকা বেশ চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে টিকে আছে, পেশাদার সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করছে।
গত ২০ বছরে দেশের অর্থনীতির অনেক উন্নতি হয়েছে। গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকেরই উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকতার মান নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। সাংবাদিকতা করপোরেট ও দলীয় আদর্শে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বলতে গেলে একটি ফরমেটেড জার্নালিজমের গণ্ডিতে নিয়ন্ত্রিত আমাদের সাংবাদিকতা। তাই সাংবাদিকতায় চলছে স্বনিয়ন্ত্রিত সম্পাদকীয় নীতি। গণমাধ্যমের কর্মীরা আগে থেকেই বুঝে ফেলেন কোনটা প্রকাশ হবে, কোনটা হবে না।
ইউকের স্বনামখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ ১৮২১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’ নামে। ১৯২১ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকার ১০০ বছর পূর্তিতে পত্রিকার সম্পাদক সিপি স্কট ‘এ হানড্রেড ইয়ার’ শিরোনামে এক নিবন্ধ লেখেন। এটি এখন পর্যন্ত পত্রিকার বর্ষপূর্তি নিয়ে লেখা সবচেয়ে শক্তিশালী নিবন্ধ। সেখানে সাংবাদিকতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, পত্রিকার ব্যবসাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেন।
সিপি স্কট ?গার্ডিয়ান পত্রিকায় ৫০ বছরের বেশি সময় কাজ করেন। তার মতে, একটি পত্রিকায় দুটি বিষয় রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো ব্যবসা, আর দ্বিতীয়টা হলো সাংবাদিকতা। তার মতে, যেহেতু নিজের আয় দিয়ে চলতে হয়, তাই এটি ব্যবসা। তবে ব্যবসার চেয়ে বড় হলো এটি একটি প্রতিষ্ঠান। একটি পত্রিকা দেশ, জাতি ও সমাজের ওপর প্রভাব ফেলে। দীর্ঘ সময়ে এটি পাঠকের মন ও বিবেকের ওপরও প্রভাব ফেলে। সংবাদপত্র মানুষের মনকে সমৃদ্ধ করে, তাদের উদ্দীপিত করে। পাশাপাশি বাজে ধরনের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র মানুষকে এর বিপরীত দিকেও ধাবিত করতে পারে। সিপি স্কট তার লেখায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলেছেন, Comments are free but facts are sacred. wZwb AviI e‡j‡Qb, ne of the virtues, perhaps almost the chief virtue, of a newspaper is its independence. Whatever its position or character, at least it should have a soul of its own.
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এ কারণে তৃতীয় বিশ্বে বিরোধী দল সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে বেশ সোচ্চার থাকে, কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর এ বিষয়ে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। পৃথিবীর দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোয় এর মধ্য দিয়েই চলছে সাংবাদিকতা।
‘বিখ্যাত পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান বিজ্ঞাপননির্ভর নয়; পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্য-সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি চলে। বর্তমান দুঃসময়ে গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকার প্রয়োজন অসীম। আমাদের কোনো শেয়ারহোল্ডার নেই, নেই কোনো বিলিয়নার মালিক। আমাদের সাংবাদিকতা রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাবমুক্ত। তাই মাসে এক পাউন্ড করে নিয়মিত সহায়তা করুন।’ গার্ডিয়ান তার ওয়েবসাইটে খুব সরল ইংরেজিতে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে। এভাবে শতাধিক দেশের লাখো পাঠকের সহায়তায় চলছে ২০০ বছরের পুরোনো পত্রিকা গার্ডিয়ান।
বাংলাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশ করা ও চালু রাখা বেশ চ্যালেঞ্জের। কারণ বিজ্ঞাপনের বাজার সীমিত, গণমাধ্যমের সংখ্যা অনেক বেশি। গত ২০ বছরে মধ্যম মানের পত্রিকায় বেসরকারি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়ানো যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে রেট কমেছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ব্যয় সংকোচনের চিন্তা করলেও সবার আগে বিজ্ঞাপন ব্যয় কমিয়ে ফেলে। অনেক নামি-দামি পত্রিকা কম দামে বিজ্ঞাপন ছাপাতে চায়। সরকারি বিজ্ঞাপনের রেট বেশ বাড়লেও বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্র কমে গেছে ই-টেন্ডারিংসহ অনলাইন বিজ্ঞাপনের কারণে। ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন দিলেও অনেকেই বিল দিতে চান না। করোনার মহামারিতে এ সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। বেসরকারি অনেক বড় গ্রুপ বিজ্ঞাপন দিলেও বিল দিতে অনেক গড়িমসি করেন। এসব নানা সমস্যার কারণে সংবাদপত্র পরিচালনা করা অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা থেকে উন্নয়নের তেমন কোনো পথও দেখছি না। কারণ বড় পত্রিকাগুলোর এ নিয়ে কোনো বিকার নেই। ছোট ও মাঝারি মানসম্মত পত্রিকাগুলো বাজার থেকে হারিয়ে গেলে তাদের ব্যবসা আরও ভালো হবে। তাই এসব তাদের কাছে নগণ্য বিষয়।
নীতি-নৈতিকতা, সততা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের বিশাল এক অভাবের মধ্য দিয়ে সময় পার করছি আমরা। এই দুঃসময়ে ছোট-বড় ও মাঝারি মানসম্মত সব ধরনের পত্রিকার দরকার রয়েছে। বাজার থেকে এসব পত্রিকা হারিয়ে গেলে সংকট আরও তীব্র হবে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে সিভিল সোসাইটি, বড় করপোরেট এবং সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে গার্ডিয়ানের মতো হাত পাতা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।