সীমান্তঘেঁষা ১২ জেলার শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে দেশে ঢুকছে মাদক। চিহ্নিত এসব পয়েন্টে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হলেও কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না মাদক চোরাচালান। মাদক কারবারিদের তৎপরতাও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে ফের কারবারে নেমে পড়েন। এ অবস্থায় দিন দিন মাদকের চোরাচালানের পয়েন্ট বাড়ছে। এসব পয়েন্ট দিয়ে ১০ ধরনের মাদক ঢুকছে। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) সূত্র এসব তথ্য দিয়ে বলেছেন, ক্রেজি ড্রাগ ইয়াবা এখন আর শুধু টেকনাফ হয়েই দেশে ঢুকছে না। ইয়াবা চোরাচালানের দ্বিতীয় গেট সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকা জকিগঞ্জ। কিছুদিন পর পরই এ এলাকায় ধরা পড়ছে ইয়াবার চালান। এ এলাকার ছোট পেশার লোকজন এখন ইয়াবা কারবারে ঝুঁকতে শুরু করেছেন।
সূত্র জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম থেকে দেশে অবাধে মাদক ঢুকছে। সীমান্ত এলাকার মাদক পাচারের শতাধিক পয়েন্ট ইতিমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব রুটে কী কী মাদক পাচার হয় সে বিষয়ে প্রতিবেশী দেশকে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। পাচারকারীরা যেন এলাকাগুলো দিয়ে মাদক আনা-নেওয়া করতে না পারে সেজন্য ভারতের নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরোকে আরও কড়া নজরদারির অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘মাদক পাচার প্রতিরোধে ভারত ও বাংলাদেশ একযোগে কাজ শুরু করেছে। সম্প্রতি আমাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। আমরা মাদক পাচারের সীমান্ত এলাকার বিষয়ে ভারতকে জানিয়েছি। তারা এ বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।’
ডিএনসির একজন কর্মকর্তা জানান, টেকনাফকে বলা হয় ইয়াবা গেট। এ একটি পথেই ইয়াবা ঢুকত বাংলাদেশে। ইতিমধ্যে ইয়াবা চোরাচালানে আরও একটি পথ তৈরি হয়ে গেছে। ইয়াবা প্রবেশের দ্বিতীয় গেট এখন জকিগঞ্জ। মিয়ানমার থেকে ভারতের মণিপুর-ইম্ফল-শিলচর হয়ে ইয়াবার চালান আসে করিমগঞ্জে। সেখান থেকে রাতের আঁধারে জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। ইয়াবা ছাড়াও দেশে ঢুকছে ১০ ধরনের মাদক। যুবসমাজ ধ্বংসের এ মাদক চোরাচালান করে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন কারবারিরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারের টেকনাফের পর সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত এখন মাদক চোরাচালানের সবচেয়ে বড় গেট। মাদক কারবারির কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, আবার কেউ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে সচরাচর ব্যবস্থা নেয় না। জানা গেছে জকিগঞ্জ সীমান্ত এলাকার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৪ কিলোমিটার। সীমান্তের উল্টো দিকে ভারতের করিমগঞ্জ ও শিলচর। দুই দেশের সীমান্তের মধ্যে একটি ছোট নদী আছে। ইয়াবা কারবারিরা ওপার-এপার করেই তাদের ভয়ংকর মাদক কারবার চালু রেখেছেন। সূত্র জানান, একটি শক্তিশালী মাদক কারবারি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরেই মাদক চোরাচালান করে আসছে। আর এ সিন্ডিকেটের গডফাদার জকিগঞ্জের পশ্চিম বেউর গ্রামের আবদুল হক। আর এই হক সিন্ডিকেটের মাদকেই ভাসছে এখন গোটা সিলেট। জানা গেছে, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে হকসহ তিনজনই মাদক কারবারি। তার এক ভাই বদরুল হকের বিরুদ্ধে রয়েছে তিনটি মামলা। চতুর্থ ভাই জায়েদুল হক এখন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি। আর নেপথ্যে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তাদের ভাই আবদুল হক। হকের বিরুদ্ধে জকিগঞ্জ থানায় মাদক মামলা ছাড়াও রয়েছে শিশু ও নারী নির্যাতন মামলা। এ ছাড়া মতিন হত্যা মামলার তিনি অন্যতম আসামি। হক সিন্ডিকেট জকিগঞ্জ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মাদক চোরাচালান করছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছেন, আবদুল হক সিন্ডিকেটের লুতফর রহমান লুতন, মহিমউদ্দিন মাদক কারবার করে বিশাল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। হক সিন্ডিকেটের প্রধান আবদুল হক সম্প্রতি একটি চ্যানেলে ইয়াবা ব্যবসায় তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নেন। ডিএনসির এক কর্মকর্তা জানান, সীমান্তঘেঁষা ১২ জেলার শতাধিক পয়েন্ট শনাক্ত করা হয়েছে চলতি বছরই। সাতক্ষীরা লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী ১২ পয়েন্ট দিয়ে হেরোইন ও ফেনসিডিল পাচার হয়। পয়েন্টগুলো হলো- কুশখালী, বৈকারি, ভাদিয়ালী, কালীগঞ্জ, শেরপুর, চান্দিপুর, ভোমরা, কাকডাঙ্গা, নোংলা, শহলপুর, বসস্তপুর ও কৈখালী। একই মাদক পাচারের জন্য যশোরে রয়েছে পাঁচ পয়েন্ট। এ ছাড়া চুয়াডাঙ্গার তিন পয়েন্ট কাপাসডাঙ্গা, দর্শনা ও জীবননগর; রাজশাহীর আট পয়েন্ট- সোনাইকান্দি, হরিপুর, কাশিডাঙ্গা, শাহানপুর, আলাইপুর, বাগা, মুক্তারপুর, চড়ঘাট দিয়ে বাংলাদেশে মাদক নিয়ে আসেন পাচারকারীরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিরণগঞ্জ, ভোলাহাট, কানসাট, আজমতপুর, চাকপাড়া, কামালপুর, শিয়ালমারা, ভাটিয়া বিল, তেলকুপি, রঘুনাথপুর, ওয়ায়েহদপুর, জহুরপুর টেক ও ফতেহপুর দিয়ে ইয়াবা, ফেনসিডিল, বিভিন্ন ইনজেকশনসহ পাঁচ ধরনের মাদক পাচার হয়। বাংলাদেশের উত্তরের জেলা জয়পুরহাটের আতাপাড়া, রামকৃষ্ণপুর, পাঁচবিবি ও ধরঞ্জি দিয়ে বুপ্রেনরফিন ইনজেকশন ও ফেনসিডিল পাচার হয় বাংলাদেশে। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ী, বিরামপুর, হিলি, হাকিমপুর, কামালপুর ও বিরল সীমান্ত দিয়ে পাচার হয় হেরোইন, এস্কাফ সিরাপ, ফেনসিডিল ও বুপ্রেনরফিন ইনজেকশন। এদিকে কুড়িগ্রাম সীমান্ত এলাকার রৌমারী ও ফুলবাড়ী দিয়ে বাংলাদেশে পাচার হয় মাদক। কোচবিহারের গীতলদহ, মেঘালয়ের আমপাতি ও আসামের সীমান্ত এলাকা থেকে আসে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, এস্কাফ সিরাপ, গাঁজা ও বুপ্রেনরফিন ইনজেকশন। লালমনিরহাটের বুড়িরহাট, শ্রীরামপুর, দহগ্রাম সীমান্তে মাদক আসে। সুযোগ বুঝে এগুলো বাংলাদেশে পাচার করা হয়। এসব সীমান্ত দিয়ে গাঁজা, বুপ্রেনরফিন ইনজেকশন, ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইন আনেন চোরাকারবারিরা। এ ছাড়া ভারতের মেঘালয়ে হাতে তৈরি মদ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাচার হয়। ব্রাহ্মণবাডিয়ার আকবরপুর, কয়াপানিয়া, আনোয়ারপুর, আখাউড়ার আজমপুর, বিজয়নগরের হরসপুর সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হয় ফেনসিডিল, এস্কাফ সিরাপ ও গাঁজা। কুমিল্লার সূর্যনগর, গোলাবাড়ী, কেরানীনগর, গাজীপুর, মাদারী, রাজেশপুর, কালিকাপুর ও বসন্তপুর সীমান্ত দিয়ে পশ্চিম ত্রিপুরা থেকে আসে গাঁজা, এস্কাফ সিরাপ, ইয়াবা ও ফেনসিডিল। ফেনীর জোয়ারকাশা, তারাকুসা, নওপুর, বাসানাতপুর, গুতুমা, চাম্বুকনগর ও কুর্মিটোলা সীমান্ত দিয়ে দক্ষিণ ত্রিপুরার মাধবনগর, জগৎপুর, কমলনগর, রাজনগর, দেবপুর, কৃষ্ণনগর, গুরুঙ্গা বাজার ও শেরপুর থেকে পাঠানো মাদক বাংলাদেশে পাচার হয়। এসব সীমান্ত দিয়ে গাঁজা ও ফেনসিডিল আসে।