২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে দেশ। প্রথম তিন বছর বাদ দিলেও গত ১০ বছরে দেশে চাল উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি ৬৩ লাখ ৫২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। এই সময়ে খাদ্য চাহিদা মেটাতে খরচ হয়েছে সর্বোচ্চ ২৯ কোটি ৪৭ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন চাল। ৬ কোটি ১৬ লাখ মেট্রিক টনের বেশি চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা, যা দিয়ে ধানের আবাদ বন্ধ রেখেও ১৭ কোটি মানুষকে দুই বছর খাওয়ানো সম্ভব। অথচ হিসাবের খাতায় থাকলেও গুদামে বা কৃষকের ঘরে নেই এই চাল। উল্টো এই ১০ বছরে আরও ১ কোটি মেট্রিক টনের বেশি চাল আমদানি করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে- হিসাবের এত চাল গেল কোথায়?
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘গ্লোবাল ফুড আউটলুক-জুন ২০২১’ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে মাথাপিছু চালের ব্যবহার গড়ে ৫০০ গ্রাম ধরে হিসাব করলে ১০ বছরে দেশে উদ্বৃত্ত চাল থাকার কথা ৬ কোটি ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু চালের ব্যবহার আরও কম এবং ধারাবাহিকভাবে কমছে। সেই হিসাবে আরও অন্তত ২ কোটি মেট্রিক টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে মাথাপিছু চালের ব্যবহার ছিল ৪১৬ গ্রাম, যা ২০১৬ সালে কমে দাঁড়ায় ৩৬৭.২ গ্রামে। ইফপ্রির জরিপ অনুযায়ী, ২০১২ সালে জনপ্রতি চালের ব্যবহার ছিল ৪৬৬.৮ গ্রাম, ২০১৬ সালে কমে হয় ৪২৫ গ্রাম ও ২০১৮ সালে দাঁড়ায় ৩৯৬.৬ গ্রামে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়া, স্বাস্থ্য সচেতনতা, কায়িক শ্রম কমে যাওয়ার মতো নানা কারণে মানুষের ভাত খাওয়ার প্রবণতা কমছে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর একটি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শতকরা ১৩ ভাগ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। নিয়মিত চিকিৎসা নেন ৩৮ লাখের বেশি মানুষ, যারা ভাত কম খান। তবে উৎপাদন ও ভোগের প্রকৃত চিত্র না থাকায় চাল নিয়ে প্রতি বছরই সংকট তৈরি হচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠছে বাজার। গত এপ্রিলে সরকারের গুদামে চালের মজুদ ৩ লাখ মেট্রিক টনে নেমে আসে, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এদিকে কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ কোটি ৪৭ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ১৩ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৬৪ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। বিবিএসের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৩ শতাংশ ধরে ২০১১-২০১২ সালে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ কোটি ১৭ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩৬ জন, ২০১২-২০১৩ সালে ১৫ কোটি ৩৭ লাখ ৮২ হাজার ৮০২ জন, ২০১৩-২০১৪ সালে ১৫ কোটি ৫৮ লাখ ২৮ হাজার ১১৩ জন, ২০১৪-২০১৫ সালে ১৫ কোটি ৭৯ লাখ ৬২৭ জন, ২০১৫-২০১৬ সালে ১৬ কোটি ৭০৫ জন, ২০১৬-২০১৭ সালে ৬৫ হাজার রোহিঙ্গাসহ ১৬ কোটি ২১ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৪ জন, ২০১৭-২০১৮ সালে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গাসহ ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৮৯০ জন, ২০১৮-২০১৯ সালে ১৬ কোটি ৭২ লাখ ৯৬ হাজার ৭৩২ জন, ২০১৯-২০২০ সালে ১৬ কোটি ৯৫ লাখ ২১ হাজার ৭৭৮ জন ও ২০২০-২০২১ সালে ১৭ কোটি ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৪১৮ জন। উৎপাদিত চাল দিয়ে এই জনসংখ্যার চাহিদা মিটিয়েও ১০ বছরে ৬-৮ কোটি মেট্রিক টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ গত ১০ বছরে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে ১ কোটি মেট্রিক টনের বেশি চাল। চলতি বছরেও আমদানি করা হয়েছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন চাল। হিসাবের এই গরমিল নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমও। তিনি বলেছেন, বিবিএসের মাথাপিছু চাল ভোগের পরিমাণ ধরে হিসাব করলে দেশে বছরে ২ কোটি ৮০ লাখ টনের বেশি চালের প্রয়োজন হয় না। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন অনেক বেশি। তার পরও আমদানি করতে হচ্ছে। কোথাও হিসাবে ভুল হচ্ছে। তবে উদ্বৃত্ত চাল কোথায় যায় তার একটা হিসাব দাঁড় করিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে দেশে প্রতি বছর গড়ে ৬৭ লাখ টন চাল নষ্ট হয়।
তবে এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হিসাবে গরমিল হলে সঠিক পরিকল্পনা করা যায় না। তখন নানা সংকট তৈরি হয়। গ্রস উৎপাদনের সঙ্গে নিট উৎপাদনের হিসাবটা থাকা দরকার। বীজ, অপচয়- এগুলো হিসাবে ধরে নিট কতটুকু ভোগের জন্য থাকবে সেই হিসাব রাখতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সরকারের আমদানির পরিকল্পনা হবে। কোন চাল কতটা আছে বা দরকার সেই হিসাবটা রাখাও জরুরি। মোটা চালের চাহিদা বেশি হলে চিকন চাল আমদানি করে তো লাভ হবে না।