ওষুধ কোম্পানির কাছে ডাক্তাররা জিম্মি বেসরকারি ডায়াগনস্টিকের তোপে অকেজো সরকারি হাসপাতালের ল্যাব, অসহায় রোগীরা

ওষুধ কোম্পানির কাছে ডাক্তাররা জিম্মি বেসরকারি ডায়াগনস্টিকের তোপে অকেজো সরকারি হাসপাতালের ল্যাব, অসহায় রোগীরা

শিমুল মাহমুদ: ফরিদ আহমেদ। ‘কিডনিতে স্টোন’ ধরা পরায় কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতালে এসেছেন চিকিৎসার জন্য। হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে বের হতেই তাকে ঘিরে ধরলেন পাঁচ থেকে ছয় জন মানুষ। হাত থেকে প্রেসক্রিপশন টেনে নিয়ে কেউ ছবি তুলছেন, কেউ আবার কাগজে লিখছেন। কাছে গেলে জানা যায় উনারা প্রত্যেকে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ (এমআর)।

হাসপাতালের ভেতরের চিত্র আরো ভয়াবহ। চিকিৎসকদের রুমের সামনে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষায় দূর দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা। অথচ অবাদে চিকিৎসকদের রুমে প্রবেশ করছেন এসব মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির হাতে দিচ্ছেন বিশেষ উপহার। আর সেটি চলছে প্রকাশ্যে রোগীদের সামনেই। রাজধানীর অন্তত ৭ টি হাসপাতাল ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এসব হাসপাতাল আসা রোগী ও রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, চিকিৎসকরা একদিকে প্রয়োজনের বেশি ওষুধ দিচ্ছেন, অন্যদিকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে যেতে হচ্ছে বেসরকারি ডায়াগনস্টিকগুলোতে।

নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এক রিপ্রেজেন্টেটিভ জানান, তাদের কাজ হচ্ছে ডাক্তারদেরকে বুঝানো। যদি তিনি রোগীর প্রেসক্রিপশনে তার কোম্পানি ঔষধ লিখেন সেক্ষেত্রে কোম্পানির সঙ্গে তার নিজেরও বেনিফিট হবে।
তিনি বলেন, হাসপাতালে থাকা চিকিৎসক তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখছেন কিনা, এবং কি পরিমানে লিখছেন, সেটার ‘ডিজিটাল প্রুফ’ দিতে হচ্ছে তাদেরকে কোম্পানিতে। তাই তারা ছবি তুলে রাখছেন।
অথচ মেডিকেলের ‘হিপোক্রেটিক ও ‘থ’ নামক একটি প্রতিজ্ঞায় রোগীর অসুস্থতার তথ্যাদি (রোগী ব্যতীত) গোপন রাখার কথা বলা হয়েছে। যা বেশিরভাগ চিকিৎসক মানছেন না।

ফলে রোগীর অজান্তেই প্রেসক্রিপশনের ছবি হয়ে এ তথ্য চলে যাচ্ছে অন্যের হাতে। যা একজন রোগীর ভবিষ্যত রেকর্ড এবং সু-চিকিৎসার জন্য এটি গোপন রাখা জরুরি।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকদের দেওয়া প্রেসক্রিপশনের ৪০ ভাগ ঔষধ প্রয়োজনের বাইরে। আর ৮৫ ভাগ পরীক্ষা নীরিক্ষা করতে হয় বেসরকারী ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এর সব কিছু শুরুটা হয় মূলত হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, হাসপাতালে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ যারা আসে তাদের সময় এক ঘণ্টা নির্ধারণ করে দিয়েছি। কিন্তু এতেও কোনো লাভ হয়নি। এখন আমরা এদের নিয়ন্ত্রন করতে এক ধরনের অ্যাপ তৈরি করছি। আশা করছি হয়তো এতে কিছুটা হলেও ফল আসবে। এছাড়া তারা যাতে বেশি সময় না থাকে এ জন্য মোটর সাইকেল রাখার জায়গায় ভাড়া বাড়িয়েছি।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, আমরা সকাল ৮ টা থেকে দুপুরে ১ টা পর্যন্ত হাসপাতালে প্রবেশ নিষেধ করেছি। তারপরও উনার কথা শুনছেন না। এ বিষয়ে খুব শিগগিরই একটা মিটিং করে এদের কিভাবে ডাক্তারদের চেম্বারে পাঠানো যায় সে বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিবো।

সম্প্রতি চিকিৎসা ব্যয়বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র তিন শতাংশ রোগী ওষুধ পান। শতকরা ৯৭ জনকেই বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। আর ১৪.৯ শতাংশ রোগী ফ্রিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পেয়ে থাকেন। বাকিদের এই সেবা নিতে হয় ডায়াগনস্টিক ল্যাব থেকে। এতে রোগীর ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদ বলেন, হাসপাতালে আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেওয়ার মাধ্যমে যথাক্রমে ১২ ও ১১ ভাগ ব্যয় হয়। এছাড়া রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা খাতে ব্যয় হয় আট ভাগ।
তিনি বলেন, ২০১২ সালে বাংলাদেশে রোগীর নিজ পকেট থেকে চিকিৎসা ব্যয় ছিল ৬৪ ভাগ, কিন্তু ২০১৫ সালে এ খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ ভাগ। তাই বলা চলে, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে উচ্চ হারে রোগীর পকেট থেকে ব্যয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আমাদের হাসপাতালগুলোতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় ৬০ ভাগ টাকা রোগীর পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে ওষুধের খরচই বেশি।
তিনি বলেন, দেশে রোগীদের দিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরীক্ষা করানো হচ্ছে। এতে রোগীদের খরচ বাড়ছে। তাই চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ, রোগীদের অযথা পরীক্ষা দেবেন না। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও

শীর্ষ সংবাদ স্বাস্থ্য