চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচন সামনে রেখে ফের মুখোমুখি অবস্থানে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতারা। প্রায় প্রতিদিন নির্বাচনি সহিংসতায় জড়াচ্ছেন দলটির দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকরা।
তাদের হামলা-পালটা হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর ও মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় বেকায়দায় পড়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। বিদ্রোহীর সমর্থকরা বলছেন, দলের নিবেদিত, পরীক্ষিত, কর্মঠ ও মাঠ পর্যায়ের জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়েছে।
আর নৌকার সমর্থকরা বলছেন, দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ বিদ্রোহ করবে— এটা এতো সহজ নয়। অবশ্যই কারো ইন্ধনেই তারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।
তৃণমূল সূত্রে জানা যায়, নৌকার মনোনীত অধিকাংশ প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতারা। তারা দল ও দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে প্রকাশ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করছেন। মূলত দলের নিবেদিত, পরীক্ষিত, কর্মঠ ও মাঠ পর্যায়ের জনপ্রিয়রা মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
তৃণমূলের বেশ কজন নেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, বিএনপিবিহীন ইউপি নির্বাচনে নিজ নিজ বলয়ের প্রার্থীদের নৌকার মনোনয়ন নিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ ও দলের প্রভাবশালী নেতারা। তাদের টার্গেট, ইউপি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজ ব্যক্তিবলয়ের রাজনীতির ভিত আরও শক্ত করা।
তাই মাঠ পর্যায়ের জনপ্রিয় ও দলের জন্য নিবেদিত প্রার্থীদের বাদ রেখে অযোগ্য, অজনপ্রিয়, সাবেক বিএনপি নেতা ও নিজ আত্মীয়দের মনোনয়ন নিয়ে দিয়েছেন তারা। ফলে ভোটগ্রহণের দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে, বিদ্রোহী ও নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থকদের নিজেদের মধ্যে হামলা-পালটা হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর ও মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের এক সভাপতি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে নৌকার মনোনীত এমপি প্রার্থীর জন্য দলের সব পর্যায়ের নেতা কাজ করেছেন। ভোটে মাঠে জয় উপহার দিয়ে সংসদ সদস্য বানিয়েছেন। এখন তিনি এমপি হয়ে ক্ষমতাধর হয়ে গেছেন। তৃণমূলের আর কোনো নেতাকে তার দরকার নেই। তার দরকার পকেটের লোক। সেই পকেটের লোককে মনোনয়ন নিয়ে দিয়েছেন। এমপিরা একজনের পক্ষ নিয়েছেন, আর বঞ্চিতরা বিদ্রোহীর পক্ষ নিয়েছেন— এটাই এখন মাঠের বাস্তবতা।
সারাদেশে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় প্রতিদিন হামলা-পালটা হামলা, মুখোমুখি সংঘর্ষ ও নির্বাচনি অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। বিএনপিবিহীন এ নির্বাচনে মুখোমুখি অবস্থানে খোদ আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা। তারা নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে তোড়জোড় শুরু করেছেন। ফলে প্রায় প্রতিদিন হামলা, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে।
গত রোববার রাতে নৌকার মনোনীত প্রার্থী মিজানুর রহমান মিজানের নির্বাচনি অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। নোয়াখালী সদর উপজেলার ৯নং কালাদরাপ ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকরা এ হামলা চালায়। এ সময় অফিসের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করা হয়। ঝিনাইদহে প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রঘুনাথপুর ইউপি নির্বাচন সামনে রেখে এ ঘটনা ঘটে। এতে ৪০ জন আহত হন বলে জানা যায়। শ্রীফলতলা গ্রামের একটি চা দোকানে দুই ইউপি সদস্য প্রার্থী সাইদুল ও রেজাউলের সমর্থকদের মধ্যে বাগ্?বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। এ ঘটনার জেরে কিছুক্ষণ পর উভয় পক্ষের লোকজন রামদা, লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
এসময় উভয়পক্ষের কমপক্ষে ৪০ জন আহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে দুই পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এছাড়া ফেনী, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই নির্বাচনি সহিংসতা বাড়ছে।
জানা যায়, বাস্তবতায় না হলেও কাগজ-কলমে বিদ্রোহীর বিরুেদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা। তারা নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী বিদ্রোহী ও তাদের সমর্থকদের দল থেকে বহিষ্কার করছেন গণহারে। কিন্তু স্থানীয় এমপিদের সাথে দূরত্ব ও এমপিবলয়ের লোক নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় নীরব ভূমিকা পালন করছেন তারা। ফলে প্রথম, দ্বিতীয় ও ধাপের মতোই চতুর্থ এবং পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে নৌকার মনোনীত প্রার্থীদের ভরাডুবি হতে পারে।
যদিও বিষয়টি জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা বলছেন, নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন, তার বিজয় নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে।
জানতে চাইলে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মশিউর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, নৌকার বিজয় নিশ্চিত করার জন্য আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন।
তিনি আরও বলেন, দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ বিদ্রোহ করবেন— এটা এতো সহজ নয়। অবশ্যই কারো ইন্ধনেই তারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। আশা করি দলের শীর্ষ নেতারা খোঁজ-খবর নিয়ে বিদ্রোহী ও তাদের ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তবে আওয়ামী লীগের দাবি, বিদ্রোহী ও তাদের মদতদাতাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। ঠিক কী কারণে নৌকার পরাজয় হচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, যেসব এমপি-মন্ত্রী বা দলের প্রভাবশালী নেতা নিদেজের ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষায় নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। এজন্য কাজ শুরু হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দেবেন, তার বিজয় নিশ্চিত করতে দলের সব ইউনিটের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু কেউ যদি বিরোধিতা করেন, তিনি যতোই প্রভাবশালী হন না কেন, তাকে ছাড় দেয়া হবে না।