অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা উবারের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যখন কোনো গ্রাহক উবারের ভাড়া আন্তর্জাতিক কার্ডে পরিশোধ করেছেন, তখন সেই অর্থ এখানকার কোনো ব্যাংকে জমা না হয়ে সরাসরি চলে গেছে নেদারল্যান্ডসের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এভাবে উবারের পরিশোধ করা ভাড়ার অন্তত ৮ লাখ ৪১ হাজার ডলার সমপরিমাণ ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাইরে আরও কোনো অর্থ পাচার হয়েছে কিনা তা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।
বাংলাদেশে দেওয়া সেবার বিপরীতে সরাসরি বিদেশের কোনো হিসাবে (অ্যাকাউন্ট) অর্থ পরিশোধ করা হলে তা আইন অনুযায়ী পাচার। উবার এভাবে অর্থ নিয়ে গেলেও এখানকার ব্যাংকগুলো পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে তা আটকাতে পারেনি। এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ১০টি ব্যাংকের সংশ্নিষ্টতা পাওয়ায় তাদের সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কার্ডে উবারের পরিশোধ হওয়া ভাড়ার কালেকটিং (সংগ্রহকারী) ব্যাংক ছিল নেদারল্যান্ডসের একটি ব্যাংক। এখানকার যে কোনো ব্যাংকের ভিসা, মাস্টারকার্ড বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক কার্ডে অর্থ পরিশোধ করলেই সরাসরি চলে গেছে ওই ব্যাংকে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কারিগরি ত্রুটি ও সুরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এভাবে অর্থ গেলেও তা বোঝা যায়নি। তবে একজন আইনজীবীর অভিযোগের পর যাচাই করে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। বেআইনি উপায়ে অর্থ নেওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত মাসের শেষ দিকে তা পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ)।
যেভাবে অর্থ গেছে :বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টের ৫/১ ধারায় বিদেশি সেবার বিনিময়ে অর্থ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সহজীকরণ ব্যবস্থার আওতায় ২০১৩ সালে একজন গ্রাহকের জন্য বছরে এক হাজার ডলার পর্যন্ত
লেনদেন ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়; বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগে না। এ সুবিধার কারণে অনেক ব্যাংক গ্রাহকের অনুকূলে আন্তর্জাতিক কার্ড ইস্যু করে এক হাজার ডলার সীমা দিয়ে রেখেছে। কার্ডগুলো সাধারণত ডুয়েল কারেন্সি তথা টাকা ও বৈদেশিক উভয় মুদ্রায় ব্যবহার যোগ্য। এই কার্ডে গ্রাহক দেশে বসেই বিদেশি সেবার বিল পরিশোধ করতে পারেন। উবারের মূল কোম্পানি যেহেতু বিদেশি এবং কালেকটিং ব্যাংক হল্যান্ডের, ফলে কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংক ও গ্রাহকের অজান্তে সেই অর্থ বাইরে চলে গেছে। কিন্তু উবার সেবা দিয়েছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের নভেম্বরে একটি সার্কুলার জারি করে এ ধরনের পরিশোধের ক্ষেত্রে সতর্ক করে। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে উৎপাদিত বা উদ্ভূত পণ্য বা সেবামূল্য আন্তর্জাতিক কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে না। আন্তর্জাতিক কার্ডের মাধ্যমে কেবল বিদেশি নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে ডাউনলোডযোগ্য অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার, ই-বুক, ম্যাগাজিন সাবস্ট্ক্রিপশন ইত্যাদির ফি, ক্লাউডবেজড সলিউশন্স, ডোমেইন হোস্টিংসহ বিদেশি সেবার অর্থ পরিশোধ করা যায়। একই সঙ্গে একক লেনদেনে ৩০০ ডলার সমপরিমাণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। এই নির্দেশনার আগ পর্যন্ত একক লেনদেনে যেখানে সর্বোচ্চ ১০০ ডলার পরিশোধ করা যেত। ২০১৯ সালের ওই নির্দেশনার পর আর অর্থ যায়নি বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দাবি করেছে ব্যাংকগুলো।
কোন ব্যাংকের কার্ডে কত গেছে :বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই শেষে বেআইনিভাবে ১০টি ব্যাংকের মাধ্যমে মোট ৮ লাখ ৪০ হাজার ৬১৬ ডলার যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে সর্বোচ্চ তিন লাখ ৬৭ হাজার ২৯৪ ডলার গেছে বিদেশি মালিকানার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কার্ড ব্যবহারকারীদের। পর্যায়ক্রমে দ্য সিটি ব্যাংকের মাধ্যমে তিন লাখ তিন হাজার ১৪৪ ডলার, ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে এক লাখ ৪২ হাজার ৪৯৩ ডলার, ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ১৯ হাজার ৩৮৮ ডলার, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন থেকে পাঁচ হাজার ৯১৭ ডলার, এনসিসি থেকে ৯১৩ ডলার, মিডল্যান্ড ব্যাংক থেকে ৩২১ ডলার, যমুনা ব্যাংক থেকে ১২১ ডলার, আইএফআইসি থেকে ১৭ ডলার এবং এনআরবি ব্যাংকের মাধ্যমে গেছে ৯ ডলার।
বিভিন্ন পর্যায় যাচাই শেষে সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে বিস্তারিত তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাঠানো হয়েছে বিএফআইইউতে।
জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব রিটেইল ব্যাংকিং মো. মাহীয়ুল ইসলাম বলেন, উবারের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট বাইরে থাকায় কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে এভাবে অর্থ গেছে। প্রথমে তারা বিষয়টি বুঝতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক ধরিয়ে দেওয়ার পর পরিশোধ পদ্ধতিতে তারা পরিবর্তন এনেছেন। এখন আর উবারের ভাড়া কার্ডে পরিশোধ করা যায় না।
উবারের বক্তব্য :সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বাংলাদেশে উবারের জনসংযোগ দেখভালের দায়িত্বে থাকা বেঞ্চমার্ক পিআরের মাধ্যমে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। কিন্তু প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে ই-মেইলে উবারের মুখপাত্র বলেন, ‘উবার বাংলাদেশের সমস্ত প্রাসঙ্গিক আইনকানুন মেনে চলে। আমরা সব বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে থাকি।’
উবারের আবেদন আগেই নাকচ হয়েছিল :২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে সেবা চালুর ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান উবার। কার্যক্রম শুরুর পরই এখানকার সেবার অর্থ সরাসরি বিদেশি মূল কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল উবার বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড। কিন্তু এ উপায়ে প্রকৃত আয়ের তথ্য গোপনের আশঙ্কায় তা নাকচ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।