ওমিক্রনের শঙ্কার মধ্যেও আগামী অর্থবছরে ছয় লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকার বিশাল বাজেট প্রাক্কলন করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ১৩ হাজার ৯৯ কোটি টাকা।
গতকাল বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের’ সভায় অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বাজেটের রূপরেখার এই প্রস্তাব করা হয়।
এরপর অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটি’র বৈঠক। সভায় অর্থনীতির সার্বিক সূচক নিয়ে আলোচনা করা হয়। সভায় বাজেটে ভর্তুকি ব্যয় কমাতে জ্বালানি তেলের পর এবার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী মাসেই বাড়তে পারে এই তিন পণ্যের দাম। অর্থ বিভাগ থেকে দাম সমন্বয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্র জানায়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, এই তিন পণ্যের দাম না বাড়ালে ভর্তুকি ব্যয় বাজেটে প্রক্ষেপণের চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে।
এর আগে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা অর্থনীতির বিদ্যমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করব। এবার রাজস্ব আদায় কত হলো, তা-ও দেখতে হবে। আমাদের সক্ষমতা বিবেচনায় নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার মতো কর্মসূচিও আমরা দেখব। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরি করা হবে।’
‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের’ সভা : অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছর ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন। বৈঠকে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছয় লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা প্রস্তাব করেছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। এটি জিডিপির ১৫.৫ শতাংশ। সে হিসাবে আগামী বাজেটের আকার ৭১ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে মোট আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৯.৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মোট আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে মোট আয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
আগামী বছরের মোট আয়ের মধ্যে এনবিআরকে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি জিডিপির ৮.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছর এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ছাড়া আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে নন-এনবিআর থেকে প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির পরও বড় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এখনো স্বাভাবিক সময় আসেনি। ব্যবসা-বাণিজ্য সবল নয়। অর্থনীতি এখনো আগের ধারায় ফিরে আসেনি। ভ্যাট থেকে আমরা বেশি আয় আশা করি। কিন্তু ভ্যাট অটোমেশনে যাওয়া যায়নি। ভ্যাট অটোমেশনে না গেলে রাজস্ব আদায় বাড়ানো কঠিন। তবে এনবিআর চেষ্টা করে যাচ্ছে।’
বৈঠকে আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সে হিসাবে ঘাটতি ২৫ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা আগামী অর্থবছরের জন্য দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার এডিপির প্রস্তাব করেছেন।
ওমিক্রন শঙ্কা নিয়েই আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ৫.৩ শতাংশ।
বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠক : দুপুরে অনুষ্ঠিত বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দাম নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, এই তিন পণ্যের দাম সমন্বয় বা বৃদ্ধি করা না হলে বাজেটে ভর্তুকি ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে, যার পরিমাণ হতে পারে জিডিপির ২ শতাংশ। এটি খুবই চিন্তার বিষয়। ভর্তুকি কমানো না হলে বাজেটের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। আর্থিক খাত বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়তে পারে। তাই সারের দাম না হলেও গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আগামী বছরের শুরুতেই সমন্বয় করা প্রয়োজন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ বাবদ ৪৯ হাজার কোটি টাকা নির্ধারিত রয়েছে।
তবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।