প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার পৌষের শিশিরভেজা সকালে আকস্মিক পদ্মা সেতু পরিদর্শন করেছেন। তিনি বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে চড়ে এবং পায়ে হেঁটে সেতু অতিক্রম করেন। তিনি ৭ নম্বর খুঁটি থেকে ১৮ নম্বর খুঁটি পর্যন্ত ১৬৫০ মিটার পথ পায়ে হাঁটেন। এরপর আবার গাড়িতে ওঠেন। এ ছাড়াও কপ্টারে করে সেতু প্রত্যক্ষ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা এক কর্মকর্তা জানান, শুক্রবার সকাল ৭টা ২৩ মিনিটে শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি সড়ক পথে পদ্মা সেতুর সার্ভিস-১ এরিয়ায় আসেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী গাড়িযোগে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে সেতুতে ওঠেন। সাড়ে ৮টার দিকের সেতুর জাজিরা প্রান্ত দিয়ে নামেন। জাজিরায় সেতুর সার্ভিস এরিয়া-২ এ তিনি নাস্তা সেরে আবার পদ্মা সেতু অতিক্রম করেন সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটে। এরপর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে সড়কপথেই গণভবন ফিরে যান। পদ্মা সেতুর কাজ দেখে প্রধানমন্ত্রী বেশ আনন্দিত ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব, মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল ও পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মোঃ আব্দুল কাদেরসহ সরকারী উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন এখন একেবারে দোরগোড়ায়। আসছে ৩০ জুন খুলে দেয়ার লক্ষ্যে পদ্মা সেতুতে চলছে ফিনিশিংয়ের কাজ। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সেতুতে সর্বশেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপনের পর একে একে বসানো হয় রেলওয়ে স্ল্যাব ও রোডওয়ে স্ল্যাব। এরপর চলতি বছরের ১০ নবেম্বর সেতুর রোডওয়ে স্ল্যাবের ওপর শুরু হয় কার্পেটিং। একই সঙ্গে স্থাপন শুরু করা হয় বাতি, যা এখনও চলমান। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সেতুর আটটি এক্সপানশন জয়েন্টের মধ্যে সবগুলোরই কংক্রিটিং সম্পন্ন হয়েছে। আর দুাটির জয়েন্টও স্থাপন হয়ে গেছে। তাই নির্বিঘ্নে পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল করতে পারছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাণের পদ্মা সেতুর শেষ পর্যায়ের কাজ সচোক্ষে দেখতে আসেন আজ শুক্রবার।
সেতুর দায়িত্বশীল প্রকৌশলী জানিয়েছেন, আসন্ন জুনে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে যা যা করা দরকার তার সবই সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আজ নিজ চোখে দেখতে এসেছেন চ্যালেঞ্জ নিয়ে নির্মাণ করা স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর রেল সংযোগের নির্মাণকাজ উদ্বোধন এবং পদ্মা সেতুর কাজ পরিদর্শন করেন। বিশ্ব ব্যাংক সরে দাঁড়ানোর পর নানা চ্যালেঞ্জের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে গোটা দুনিয়ায় তাক লাগিয়ে দেন। পরবর্তীতে বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মায় স্বপ্নের সেতু নির্মাণ বাস্তবায়ন একেবারে শেষপর্যায় নিয়ে আসার পর বিশ্বে বাংলাদেশ তথা বাঙালী জাতি একটি বিশেষ উচ্চতায় আসীন হয়। আর প্রধানমন্ত্রীর এই প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য বদল ছাড়াও গোটা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হবে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। মূল সেতু নির্মাণে কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো কর্পোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাঠামো। প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি আগামী বছর ২০২২ সালের জুন মাসে যানবাহন চলাচলের জন্য পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার কথা রয়েছে।
চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ ॥ পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দিতে চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ। সেতুর বড় বড় সব কাজ শেষ করার খুঁটিনাটি অবকাঠামোর কাজও এখন শেষ প্রায়। বাঙালী জাতির মর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য বদলে দেয়ার এই সেতু এখন জৌলুস ছড়াচ্ছে নদীর এপাড়-ওপাড়। আর দুপাড়ের সেতুবন্ধনে এখন পদ্মাপাড়ের মানুষগুলো পুলকিত।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল সেতুর ৮টি মুভমেন্ট জয়েন্টের সবগুলোরই কংক্রটিং সম্পন্ন এখন। দুটির জয়েন্টও বসে গেছে। জয়েন্ট সব বসে গেলেই আরও স্মুথলি গাড়ি চলবে। একই সঙ্গে সেতুর ঘষামাজাও চলছে। সেতুর প্রকৃত রূপ ফোটাতে ব্যস্ত সময় পার করছে কর্মীরা।
আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেতুর চমৎকার নির্মাণশৈলী ফুটে ওঠায় খুশি পদ্মাপাড়ের মানুষ। পদ্মা সেতু দেশ-বিদেশে আলোচিত নানা কারণে।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা নদীতে এমন সেতু নির্মাণ বিস্ময়কর। সেতুর সার্বিক অগ্রগতি ৮৯ শতাংশের বেশি। আর মূল সেতুর অগ্রগতি গ্রায় ৯৬ শতাংশ।
বাঙালীর ঝিলিক ॥ পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দিতে চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ। সেতুর বড় বড় সব কাজ শেষ করার খুঁটিনাটি অবকাঠামোর কাজও শেষ প্রায়। পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দিতে চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ। সেতুর বড় বড় সব কাজ শেষ করার খুঁটিনাটি অবকাঠামোর কাজও শেষ প্রায়।
মুভমেন্ট জয়েন্টের কাজও সম্পন্ন হওয়ার পথে। আর গ্যাসলাইনের কাজও অর্ধেকের বেশি স্থাপন হয়ে গেছে। পুরো দৃশ্যমান স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এখন ক্রমেই যান চলাচল উপযোগী হয়ে উঠছে।
চলছে এখন শেষ পর্যায়ের কাজ। সেতুর প্যারাপেট ওয়াল ও ডিভাইডার কাজ শেষ হওয়ার পর মুভমেন্ট জয়েন্টের কাজও সম্পন্ন হওয়ার পথে। আর গ্যাসলাইনও অর্ধেকের বেশি স্থাপন হয়ে গেছে। নিচতলায় রেলওয়ে স্ল্যাবের ওপরের কংক্রিটিংও সম্পন্ন। সেতুর নান্দনিক নির্মাণশৈলীর প্রকৃত রুপ ফুটে উঠতে শুরু করেছে। নদী শাসনের কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে এখন। সেতুর দুই পাশের ভায়াডাক্টের সেেঙ্গ এক্সপ্রেসওয়ের যুক্ত করার কাজও শেষ। আগেই বসানো হয়েছে টোল প্লাজা। মুভমেন্ট জয়েন্টের কাজ শেষ হলেই সেতুর কার্পেটিং কাজে গতি পাবে। মূল সেতুর অগ্রগতি ৯৫ শতাংশের বেশি, বলে জানালেন সেতুর প্রকল্প পরিচালক। বাংলাদেশের সক্ষমতার স্মারক এই সেতু আগামী ৩০ জুন খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।