ডোনেশনের নামে ভারতে কিডনি ও লিভার পাচার করে আসছিল সংঘবদ্ধ একটি চক্র। যার অবস্থান চট্টগ্রামে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগরীর খুলশী এলাকায় ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রে সাইফুল নামে এক ব্যক্তির ভিসার আবেদন করতে গিয়ে র্যাবের হাতে ধরা পড়ে এই চক্রের তিন ব্যক্তি।
এরা হলেন- মুন্সীগঞ্জ জেলার বাসুদিয়া গ্রামের মো. মতিউর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ আলী ডালিম (৩৫), কিশোরগঞ্জ সদরের আখড়া বাজার এলাকার মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে আতিকুর রহমান রনি (৩৬) ও মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার সম্বুক এলাকার মৃত মুজিবুর রহমানের ছেলে আলম হোসেন (৩৮)। যারা জিজ্ঞাসাবাদে মানবদেহের কিডনি ও লিভার পাচারকারী সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক চক্রের বিভিন্ন তথ্য দেন।
এর আগে ১২ অক্টোবরের রাজধানী ঢাকা ও জয়পুরহাটে অভিযান চালিয়ে কিডনি কেনাবেচায় জড়িত একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব-২। তাদের কাছ থেকে চট্টগ্রামে ধরা পড়া কিডনি ও লিভার পাচার চক্রের তথ্য পায়। আর এ তথ্য থেকে র্যাব নিশ্চিত হয়েছে আন্তর্জাতিক কিডনি ও লিভার পাচার চক্রের শেকড় চট্টগ্রামে। যাদের সন্ধানে এখন কাজ চলছে।
এমন তথ্য জানিয়েছেন র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ ইউসুফ। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ধরা পড়া ডালিম কিডনি-লিভার পাচার চক্রের বাংলাদেশের প্রধান। রনি, আলম ঢাকা ও জয়পুরহাটে ধরা পড়া শাহরিয়ার ইমরান (৩৬), মেহেদী হাসান (২৪), সাইফুল ইসলাম (২৮), আব্দুল মান্নান (৪৫) ও তাজুল ইসলাম ওরফে তাজুর (৩৮) মাধ্যমে কিডনি ও লিভারের ডোনার সংগ্রহ করেন।
ডোনার সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম থেকে তাদের ভারতে পাচারের ব্যবস্থা করেন ডালিম, আলম ও রনি। ভারতে অবস্থান করা শাহিন ডোনারদের তত্ত্বাবধান করেন। শাহিনের মাধ্যমে প্রতিজন দাতার বিপরীতে ১৫-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আসত ডালিম চক্রের কাছে।
অথচ ২-৪ লাখ টাকায় কিডনি-লিভার বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলত ডোনারদের। ফেসবুক পেজে প্রচারণা চালিয়ে চক্রের সদস্যরা এই কাজ করত। প্রতারণার শিকার হওয়া কয়েকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-২ কিডনি ও লিভার ডোনেশনের আড়ালে কেনাবেচা চক্রের তথ্য সংগ্রহে নামে।
শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার পেশেন্ট চিকিৎসাসেবা এবং কিডনি-লিভার চিকিৎসাসেবা নামে দুটি পেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়। এ দুটি পেজের অ্যাডমিন ছিলেন শাহরিয়ার ইমরান (৩৬)। তার বিরুদ্ধে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ছয়টিরও বেশি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগী কিডনি দাতাদের চারটি পাসপোর্ট, মেডিকেল চিকিৎসার জন্য বিশেষ পাসপোর্ট ও ভিসা সম্পর্কিত বেশ কিছু নথিপত্র, পাঁচটি মোবাইল ফোন ও দেশি-বিদেশি মুদ্রাও জব্দ করা হয়। তাদের তথ্যের সূত্র ধরে ৩০ ডিসেম্বর র্যাব-৭-এর একটি দল চট্টগ্রামের খুলশীর জাকির হোসেন রোডের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে একই কায়দায় ডালিম চক্রের কাছ থেকেও বিভিন্ন নথিপত্র জব্দ করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তাদের দাবি, এই চক্র আর্থিক সঙ্কটে পড়া লোকদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে কিডনি ও লিভার সংগ্রহ করতেন। বিশেষ করে করোনাকালে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীরাই তাদের টার্গেট। পাশাপাশি দরিদ্র লোকদেরও টার্গেট করেন তারা। সম্প্রতি সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় কিডনি ডোনেট করার প্রলোভন দেখিয়ে চট্টগ্রামে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল।
শুধু সাইফুল নন, অসহায় এমন অনেক লোকের কিডনি ও লিভার ভারতে পাচার করে আসছিল তারা। র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর অন্তত ৪০ জন ব্যক্তির কিডনি-লিভার পাচারের তথ্য দেন তারা।
ডালিমের দেওয়া তথ্য মতে, কিডনি ও লিভার দাতাদের উৎসাহিত করতে ফেসবুক পেজে প্রলোভন দেখায়। রাজি করানোর পর ওই ব্যক্তিকে পাসপোর্ট-ভিসার ব্যবস্থা করিয়ে দেন। দেশের ল্যাবে পরীক্ষা করে রোগীর সঙ্গে দাতার সব কিছু ম্যাচ করলে তাকে ভারতে পাচার করে। সেখানে যাওয়ার পর আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো সমস্যা না পেলে তাদের কাছ থেকে কিডনি ও লিভার সংগ্রহ করেন তারা। পরে কিডনি বা লিভারদাতা ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়লে লাপাত্তা হয়ে যান চক্রের সদস্যরা।
র্যাব-৭-এর জনসংযোগ কর্মকর্তা নিয়াজ মোহাম্মদ চপল বলেন, আটককৃতরা দেশে কিডনি-লিভার পাচার চক্রের অনেক সদস্যের তৎপর থাকার তথ্য দিয়েছেন। এসব সদস্যসহ ভারতে অবস্থান করা শাহিনের অনুসন্ধানে কাজ করছে র্যাব। আটকদের বিরুদ্ধে খুলশী থানায় মামলা করা হয়েছে।