করোনাভাইরাস মহামারির নতুন ধরন ওমিক্রনের আতঙ্ক এখন বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশেও বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। এ পরিস্থিতি সরকারকে ভাবাচ্ছে নতুন করে। সরাসরি অফিস-আদালত শুরু হলেও আবারও যে কোনো সময় লকডাউন ডাকতে হতে পারে এমন আশঙ্কাই ঘুরপাক খাচ্ছে নীতিনির্ধারকদের ভিতর। স্কুল-কলেজসহ সামগ্রিক কার্যক্রমে আবারও আসছে অনলাইননির্ভরতা। এমন পরিস্থিতিতেই ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছে সরকার। আসছে বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যদিও বাজেট প্রস্তুতের মূল কাজ শুরু হবে মার্চের গোড়ায়।
করোনাভাইরাস মহামারির এ প্রাক্কালে আসছে আরও একটি নতুন বাজেট। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৫ দশমিক ৫ আর চলতি অর্থবছরের বাজেটের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আসছে বছরের বাজেটে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন জিডিপির প্রবৃদ্ধির টার্গেট ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে (২০২১-২২) বাজেটে এর টার্গেট ৭ দশমিক ২ শতাংশ। সামনের বছর বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশে সীমিত রেখে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছে সরকার, যা জিডিপির ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরো সময়টা কেটেছে করোনা মহামারিতে। সে সময় দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট ঘোষণা করা হয়। বিপর্যস্ত অর্থনীতি চাপ সামলে অনেকটা ঘুরেও দাঁড়ায়। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি ফেরার আগেই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে ওমিক্রনের আঘাত, যার বাইরে নয় বাংলাদেশও। এমন পরিস্থিতিতে সামগ্রিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে আসছে নতুন বাজেট। এ বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাত অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
বৈঠকের কার্যপত্রের তথ্যমতে করোনা মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের পথে থাকায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার। আর মানবসম্পদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়াতে না পারলে এসব লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না। ফলে রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআরকে তাগিদ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। তবে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ যেন কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে এনবিআর কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গত বছরের মতোই এবারের প্রেক্ষাপট খুবই চ্যালেঞ্জের। মানুষের আয় কমে গেছে। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিতেও বিরাজ করছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। ফলে আসছে বছরের বাজেটটাও কঠিন এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে উপস্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার।’ এ বছর বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকেই প্রাধান্য দিতে তাগিদ দিয়েছেন তিনি। এদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৬৭ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছেন, চলতি অর্থবছর মোট ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে সরকার, যা জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে এনবিআর-বহির্ভূত কর থেকে ১৬ হাজার কোটি এবং করবহির্ভূত ৪৩ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাক্কলন করে মোট ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্য স্থির করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে এনবিআর-বহির্ভূত কর থেকে ১৮ হাজার কোটি এবং করবহির্ভূত খাত থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের একাধিক সূত্র।
বৈঠকের কার্যপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, কভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে। এতে কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান ও উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধন সহজ হবে। এজন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির ৩২ দশমিক ২ শতাংশ বিনিয়োগ প্রাক্কলন করা হচ্ছে প্রাথমিকভাবে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ২৫ দশমিক ৩ ও সরকারি খাতে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ বিনিয়োগ আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সূত্র জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকার প্রাক্কলিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপির আকার ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পরিচালন ও অন্যান্য খাতের ব্যয় হচ্ছে ৪ লাখ ২৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে এসব অঙ্কের কোনোটাই এখনো চূড়ান্ত নয়। এসব প্রাথমিক অঙ্ক। চলতি অর্থবছর ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা ছিল জিডিপির ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
এদিকে প্রতি মুহূর্তেই করোনা মহামারির সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নতুন করে যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে নতুন বিধিনিষেধ আরোপের কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এসব বিষয়কেই আসন্ন বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।